হযরত আবু বকর সিদ্দিক ( রা . ) জীবনী |১ম পর্ব

 


হযরত আবু বকর ( রা . ) এর প্রাথমিক জীবন ও খিলাফত লাভ : হযরত আবু বকর সিদ্দিক ( রা . ) ( ৬৩২-৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ ) ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম জাহানের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর ( রা ) । নবি - রসুলগণের পরই তাঁর মর্যাদা । ইসলামের নবি পরই তাঁর স্থান । ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি অন্যান্যদের জাহেলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিলেন না বরং পুত - পবিত্র চরিত্রের লোক ছিলেন ।

 তিনি আজীবন রাসূলুল্লাহর পাশে ছিলেন ছায়ার মতো । নবুয়াতের আগে ও নবুয়াত লাভের পরে হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) কে সমানভাবে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে তিনি তাঁকে অনুসরণ করেছেন । ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর জীবন - চরিত্র আরও উন্নততর হয়ে উঠে । প্রাথমিক জীবনে তিনি মানবতার সেবা করতেন । ইসলাম গ্রহেণের পরে তিনি আরও বেশি দুর্গত মানবতার সাহায্যে এগিয়ে আসেন । ইসলামের সেবায় তিনি তার সমুদয় ধন সম্পত্তি সম্পূর্ণরূপে বিলিয়ে দিয়েছিলেন ।

তাঁর প্রকৃত নাম আবদুল্লাহ । উপনাম ছিল আবু বকর । আতিক ও সিদ্দিক ছিল তার উপাধি । তার পিতা হলেন হযরত ওসমান ওরফে আবু কুহাফা এবং মাতা ছিলেন হযরত সালমা ওরফে উম্মুল কায়ের । তার পিতামাতা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন । তিনি মক্কার কুরাইশ বংশের ‘ তাইম ’ গোত্রে ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর প্রায়  তিন বছরের ছোট ছিলেন । হযরত আবু বকর ( রা . ) জাহেলিয়াতের যুগে বিরাট ব্যবসায়ী ও সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন । এ উপলক্ষে তিনি একাধিকবার সিরিয়া ও ইয়ামেন সফর করেন ।

 আঠার বছর বয়সে প্রথম বারের মতো তিনি বিদেশ সফর করেন । কুরাইশ বংশের সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন গোত্র আরবের বিভিন্ন সেবামূলক কার্যের জিম্মাদার ছিলেন । রক্তপণ আদায়ের জিম্মাদারী তাঁর উপর ন্যাস্ত ছিল । বংশ গণনায়ও তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন । বাল্যকাল থেকেই হযরত বকর ( রা ) উত্তম স্বভাব চরিত্রের অধিকারী ছিরেন । ইসলাম গ্রহণের আগে থেকেই তিনি মূর্তিপূজা ও মদ্যপানকে ঘৃণা করতেন ।

উঁচু মর্যাদা : আরবে যথারীতি কোন বাদশাহ বা শাসনকর্তা ছিল না । হযরত আবু বকর ( রা . ) কুরাইশ বংশের সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন পুরুষ ছিলেন । হযরত আবু বকর ( রা ) জ্ঞান - বুদ্ধি , ধৈর্য ও সহনশীলতায় অত্যন্ত খ্যাতিমান ছিলেন । একটি বর্ণনায় আছে যে , তিনি কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন । অবশ্য ইসলাম গ্রহণের পর তিনি কাব্য চর্চা পরিত্যাগ করেন । ইবনে সায়াদ নবি করীম ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর শোকগাঁথায় হযরত আবু বকর ( রা ) এর কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছেন ।

 সভাব - চরিত্র : আবু বকর ( রা ) উত্তম স্বভাবের ছিলেন । হযরত আবু বকর ( রা ) -এর প্রকৃতি ছিল হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর সাথে সামঞ্জস্যশীল । সমবয়সী ও একই স্বভাব - প্রকৃতির অধিকারী হওয়ার কারণে হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) ও হযরত আবু বকর ( রা ) এর মধ্যে ঘনিষ্টতা ছিল । ইসলাম গ্রহণের পর এই সম্পর্ক এত নিবিড় হয় যে , হযরত আয়েশা ( রা . ) বলেন- আমাদের এমন কোনোদিন অতিবাহিত হয়নি , যেদিন রসুলুল্লাহ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) সকাল - সন্ধ্যায় আমাদের গৃহে পদার্পণ করেননি ।


ইসলাম গ্রহণ : হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) - এর উপর যখন ওহি নাযিল হয় তখন হযরত আবু বকর ( রা . ) বাণিজ্য উপলক্ষে ইয়ামেনে ছিলেন । যখন তিনি ফিরে আসেন তখন কুরাইশ নেতৃবৃন্দ তার সাথে দেখা করতে যান । তিনি তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করেন কোনো নতুন খবর আছে ? তারা উত্তর দিল , “ হ্যাঁ এক নতুন খবর আছে , আর তা হলো আবু তালিবের এয়াতীম বাচ্চা নবুয়তের দাবী করেছে । এ শুনে হযরত আবু বকরের অন্তর কেঁপে উঠল । কুরাইশ নেতৃবৃন্দ তাঁর নিকট হতে চলে যাওয়ার পর তিনি সরাসরি নবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর খেদমতে গিয়ে হাজির হন এবং তাঁকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন । শেষ পর্যন্ত ঐ বৈঠকেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন । নবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) বলেছেন , আমি যার নিকটই ইসলামের দাওয়াত পেশ করি , তিনি কোনোরূপ চিন্তা - ভাবনা ছাড়াই সাথে সাথে তা গ্রহণ করছিলেন । বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বপ্রথম মুসলমান । 

ইসলামের জন্য আত্মত্যাগ :  ইসলামের জন্য এ আত্মত্যাগকারী ব্যক্তি অনেক দুঃখ - কষ্ট ভোগ করেছেন । হযরত আবু বকর ( রা ) নিজের জন্য কখনো ভাবতেন না । তিনি ভাবতেন যেন নবি করীম ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর কোন কষ্ট না হয় । হযরত আলী ( রা ) বলেন , একদিন আমি দেখি নবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) কে কুরাইশরা বেষ্টন করে আছে । কেউ তাকে ধরে টানছে , আবার কেউ ধাক্কা দিচ্ছে । 

সবাই সমস্বরে বলছে— তুমি সেই ব্যক্তি , যে সব খোদাকে এক করে দিয়েছে হযরত আলী ( রা . ) বলেন ঐ দৃশ্য এত ভয়ানক ছিল যে , আমাদের কারও নবি করীম ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর নিকট যাওয়ার সাহস যায়নি । ঠিক তখনই হযরত আবু বকর ( রা . ) এগিয়ে আসলেন , কুরাইশদের ধাক্কা দিয়ে নবিজীকে মুক্ত করলেন । তিনি সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন । ইসলাম গ্রহণ করার পর তার সমুদয় অর্থ ইসলামের জন্য ব্যয় করেন । তিনি অনেক দাস দাসীকে তাদের মনিবদের নির্যাতন হতে মুক্ত করার বিপুল অর্থে খরিদ করে মুক্ত করে দেন । হযরত বিলাল ( রা . ) কে মুক্ত করা সম্পর্কে হযরত উমর ( রা . ) মন্তব্য করেছেন : “ হযরত আবু বকর ( রা . ) আমাদের নেতা , তিনি আমাদের নেতাকে আযাদ করেছেন । ”

হযরত আবু বকর ( রা . ) এর আর্থিক ত্যাগ সম্পর্কে মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) বলেছেন , “ আবু বকর - এর সম্পদ দ্বারা আমার যে উপকার হয়েছে , অন্য কারো সম্পদ দ্বারা সেরূপ হয়নি । ” অন্য এক জায়গায় রসুলুল্লাহ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) অত্যন্ত করুণা ও কৃতজ্ঞতার সাথে বলেন , “ নিঃসন্দেহে জান ও মালের দিক দিয়ে আমার উপর আবু বকর ( রা . ) এর চেয়ে অধিক অনুগ্রহ অন্য কারো নেই । ”

 যখন হযরত আবু বকর ( রা . ) ইসলাম গ্রহণ করেন , তখন তাঁর নিকট চল্লিশ হাজার দিরহাম জমা ছিল । কিন্তু যখন তিনি মদিনায় পৌঁছেন তখন তাঁর নিকট পাঁচ হাজার দিরহাম অবশিষ্ট ছিল । তিনি ছিলেন নবি করীম ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর হিজরতের সাথী ও গুহার সাথী । তিনি নবি করীম ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর সাথে সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন । 

খলিফা হিসেবে হযরত আবু বকর ( রা . ) এর প্রথম ভাষণ খলিফা নির্বাচিত হওয়ার প্রথম ভাষণে হযরত আবু বকর ( রা . ) বলেনঃ হে মুসলমানগণ ! আমাকে নেতা নির্বাচন করেছেন , যদিও আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম নই যদি আমি ভালো কাজ করি , আমাকে সাহায্য করবেন , যদি অন্যায় ও খারাপ কাজের দিকে যাই , আমাকে সঠিক পথে এনে দিবেন । শাসকদের নিকট সত্য প্রকাশ করাই উত্তম আনুগত্য । সত্য গোপন রাষ্ট্রদোহীতার শামিল । যে জাতি আল্লাহর পথে জিহাদ করে না , তারা লাঞ্ছিত অভিশপ্ত হয় । যে জাতির মধ্যে খারাপ কাজ ব্যাপক হয় , তাদের উপর আল্লাহ বালা - মুসিবত ব্যাপক করে দেন । '

হযরত আবু বকর ( রা . ) গণতান্ত্রিক পন্থায়ই খলিফা নির্বাচিত হয়েছিলেন । হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) রোগ শয্যায় শায়িত থেকে তাঁকে নামাযের ইমামতির ভার দিয়েছিলেন । এর মধ্যে এই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল যে , তাঁর তিরোধানের পর আবু বকর খিলাফত প্রাপ্ত হবেন ।

 গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ : হযরত আবু বকর ( রা . ) খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন । ভিগুনবিদের আবির্ভাব , গষধর্ম ত্যাগীদের বিদ্রোহ ,  যাকাত অস্বীকারকারীদের গোলযোগ ,এছাড়াও হযরত উসামা ইবনে যায়েদের ঘটনা , যাকে রসুল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) আপন জীবদ্দশায় মুতার যুদ্ধের শহীদানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সিরিয়া হামলার শুধু আদেশই দেননি , নিজ হাতে তাঁর পতাকা বেঁধে দিয়েছিলেন । এতে অধিকাংশ বড় সাহাবীর অংশগ্রহণের নির্দেশ ছিল । 

অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সময় সেনাবাহিনীর মদিনার বাইরে যাওয়া কম বিপদজ্জনক ছিল না । দৃঢ় মনোবল ও সাহসিকতায় হযরত আবু বকর ( রা . ) এ সমস্যার সাফল্যজনক মোকাবেলা করেছিলেন ।  মূলত তখন সঙ্কটের এক পাহাড় যে রসুলুল্লাহ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর খলিফার সামনে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে ছিল ।

 হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ( রা . ) বর্ণনা করেন , রসুলুল্লাহ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর ইনতেকালের পর মুসলমানদের এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় যে , যদি আল্লাহতায়ালা হযরত আবু বকর ( রা ) এর মাধ্যমে আমাদের উপর করুণা না করতেন , তাহলে আমরা ধ্বংস হয়ে যেতাম । হযরত আয়েশা ( রা ) বলেন , রসুলুল্লাহ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর ইনতেকালের পর আমার পিতার উপর এমন সব আকস্মিক বিপদ আপতিত হয় যে , যদি তা কোন বিরাট পাহাড়ের উপর নাযিল হত তা হলে সে পাহাড়ও টুকরা টুকরা হয়ে যেত । একদিকে মদিনায় মুনাফিকদের উৎপত্তি , অন্যদিকে আরবের প্রায় সর্বত্র ইসলাম ত্যাগের হিড়িক । 

রিদ্দা বা স্বধর্ম ত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ : মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর ইনতিকালের পর মক্কা ও মদিনা ব্যতীত সমগ্র আরবে ধর্মত্যাগ ও বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে । ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর ( রা . ) এর সময়ে স্ব - ধর্ম - ত্যাগী মুরতাদ , ভন্ড নবির আবির্ভাব যাকাত প্রদানে অনিচ্ছা প্রভৃতি স্পর্শকাতর বিষয়সমূহ মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের ভীত নড়বড় করে তোলে । এমতাবস্থায় হযরত আবু বকর ( রা . ) অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এসবের সমাধানকল্পে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । ইতিহাসে একেই ‘ রিদ্দার যুদ্ধ ’ বলা হয় । হযরত আবু বকর ( রা . ) তাঁর স্বল্পকালীন খিলাফতের বেশিরভাগ সময় এ যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন ।

 রিদ্দা যুদ্ধের কারণ : ইসলাম প্রসারে  রসুল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর ইনতিকালের পূর্বে আরবের বিভিন্ন গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেছিল । ফলে ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও জীবনাদর্শের মূল অনুশাসন সম্পর্কে তাদের অনেকেই অজ্ঞ ছিল । এছাড়া দীর্ঘকাল যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থাকা , যোগাযোগের অভাব , সময়ের স্বল্পতা , সংঘবদ্ধভাবে ইসলাম প্রচারের অভাবে এসব লোকজন ইসলামের বিরোধিতা শুরু করে ।

 মদিনার প্রাধান্য ও অস্বীকার : রসুলের জীবদ্দশায়ই মদিনা ইসলামের প্রাণকেন্দ্র ও রাষ্ট্রের রাজধানী হওয়ার গৌরব অর্জন করে । কিন্তু তার ইন্তেকালের পর মক্কায় একশ্রেণির লোক ও অন্যান্য কুচক্রী মহল মদিনার প্রাধান্যকে অস্বীকার করে ঐতিহাসিক পি.কে.হিট্টি বলেন - হিজাজ রাজধানীর প্রাধান্য ও তাদের ঈর্ষার এবং বিদ্রোহের ( বিদ্ধা যুদ্ধের ও ) অন্যতম কারণ ছিল ।

 ব্যক্তি স্বার্থে আঘাত : আরববাসীদের মধ্যে গোত্রপ্রীতি , স্বজনপ্রীতি , স্বাতন্ত্রবোধ , ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নেতৃত্বের লোভ ছিল । কিন্তু ইসলাম প্রতিষ্ঠার ফলে এসব বিলীন হয়ে যায় । প্রতিষ্ঠিত হয় ভ্রাতৃত্ববোধ , সাম্য - মৈত্রীর সুমহান আদর্শ । ফলে বেদুইনদের মনে দারুণ আঘাত হানে । তারা যেহেতু গোত্রের দলপতিকে অন্ধের মতো অনুসরণ করতো , তাই গোত্রপতির ধর্ম ত্যাগের সাথে সাথে তারাও ধমর্ত্যাগী হয়ে বিদ্রোহ করে । 

 নবুয়ত প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা : নবুয়তের পদ ছিল অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ । তাই কতিপয় লোক সম্মান ও পদমর্যাদার লোভে মিথ্যা নবুয়াতী দাবী করে আর মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে আরবাসীদেরকে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে ।

 ইসলামের বৈপ্লিবিক পরিবর্তনের বিরোধিতা : প্রাক ইসলামি যুগে আরবে এমন কোনো অন্যায় কাজ ছিল না যা আরববাসীরা করতো না । রসুল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সকল স্তরে আমুল পরিবর্তন করেন । শতকরা বিচ্ছিন্ন একটি জাতিকে সুশৃঙ্খল সুসভ্য জাতিতে পরিণত করেন । এতে বেদুইনরা খুশি হতে পারেননি । কাজেই তাঁর মৃত্যুর পর স্বার্থপর বেদুইনরা ইসলামের বিধানের বিরোধীতা শুরু করে । 

ইসলামের নৈতিক অনুশাসনের বিরোধিতা : ইসলামের নৈতিক অনুশাসন , রুচিসম্মত ও মার্জিত জীবযাত্রায় স্বাধীনচেতা অনুশাসনমুক্ত আরববাসীরা অভ্যস্থ ছিল না । চিরদিনই তারা ছিল দূরন্ত বাধা - বান্ধনহীন । তাই ইসলামের সালাত , যাকাত , সাওম প্রভৃতি নৈতিক অনুশাসনকে তারা মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি । বরং নিজেদের উপর এগুলোকে জুলুম মনে করলো । আর এ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ইসলাম ত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ হল ।

 যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি : রিদ্দা যুদ্ধের অন্যাতম কারণ ছিল যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি । আরবের কতিপয় লোক মনে করলো , এ যাকাত ব্যবস্থা নবির সম্পর্কযুক্ত ছিল । নবি যেহেতু ইনতেকাল করেছেন , তাই এর প্রয়োজন নেই ফলে তারা আবু বকর ( রা ) এর খিলাফতের সময় যাকাত দিতে অস্বীকার করলো । 

অমুসলিম সম্পাদায়ের বিরুদ্ধাচরণ : এক দিকে ইসলাম ত্যাগী বেদুইন স্বার্থান্বেষী গোত্রপতি ও ভন্ডনবিদের অপতৎপরতা শুরু হয় অন্যদিকে বিধর্মীদের মধ্যে ইহুদি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা এ মোক্ষম সুযোগ বুঝে ইসলামের বিরোধিতা বাড়িয়ে দেয় এদের ইন্ধনে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে ।

 বিচার বুদ্ধি অভাব : পরিবেশের অভাবে আরবদের মন ও মস্তিষ্ক সুষ্ঠুভাবে বিকাশ লাভ করতে পারেন । ফলে বিচার - বৃদ্ধি তাদের খুব কম ছিল । তারা অনেকেই আবেগে আপ্লুত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেও পরে অস্থির খেয়ালী মনের দ্বারা পরিচালিত হয়ে এর বিরুদ্ধাচরণ করে । এসব কারণে আরবের বিভিন্ন গোত্রের মানুষ ইসলাম ত্যাগ করে পুরোনো ধর্মে ফিরে যাওয়ার জন্য আন্দোলন সৃষ্টি করে । প্রথম খলিফা আবু বকর ( রা . ) এই আন্দোলন কঠোর হাতে দমন করেন ।

 ****** রিদ্দা যুদ্ধের ফলাফল ******

 ইসলামের অখন্ডতা বজায় : ইসলামি যুগে আরব বিভিন্ন জাতি , গোত্র ও এলাকায় বিভক্ত ছিল । ইসলাম এসে অখণ্ড জাতি হিসেবে আরবকে মর্যাদার আসন দেয় । কিন্তু নবিজীর ইনতেকালের পর আরববাসীরা বিভক্ত হয়ে পড়লে পুনরায় আবু বকর ইসলামের অখন্ডতা বজায় রাখতে সক্ষম হন । 

স্থায়ী মর্যাদা লাভ : মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার ভন্ডনবিদের ওপর জয়লাভের পর ইসলাম অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে স্থায়ী মর্যাদা লাভ করলো ।

 মুসলমানদের ইমানী শক্তি বৃদ্ধি : রসুল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর ইনতিকালের অল্পকালের মধ্যেই ইসলামের এ ধরনের ব্যর্থতা দেখে অনেক মুসলমানের মনেও সংশয় ছিল হযরত আবু বকর ( রা . ) এর দৃঢ় প্রতিরোধের মুখে সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হলে মুসলমানদের অন্তরে ইমানী শক্তি বৃদ্ধি পায় ।  

রাষ্ট্রে ভিত্তি সুদৃঢ় : মদিনার ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে শক্ত হাতে ধর্মত্যাগী ও বিদ্রোহীদের দমন করা হলে এ রাষ্ট্রের শক্তি ও ভিত আরো সুদৃঢ় হয় , যা বিরোধীদের কাছে অপরাজেয় মনে হয়েছিল ।

জয়ের দিগন্ত উন্মোচন : অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দমনের পর আরবের বাইরে ইসলামের শক্তি সম্প্রসারণ করার অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয় । এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হযরত আবু বকর ( রা ) ইরাক , সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল জয় করেন এবং এরই সাথে ইসলামের জয়ের দিগন্ত উন্মোচিত হয় ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ