গল্প: সংসার || Story Family

 


মুরগির একটা কলিজা কোনোদিনও আমার দুই বছর বয়সী ছেলেটার মুখে উঠে না। অথচ এ বাড়িতে মুরগি রান্না হলে একসাথে তিনটা রান্না হয়।

 মুরগি পরিস্কার থেকে কেটে সমস্ত মসলা বেঁটে আমি'ই রান্না করি, প্রায় একা হাতে। তবুও কখনও মুখ ফুটে বলতে পারি না আমার ছেলেটার জন্য একটা কলিজা রাখেন মা! একই পরিবারের পাঁচটা ছোট বাচ্চা সবচেয়ে ছোট আমার ছেলেটাই।  

তারপরও সবকিছুতে এতো বৈষম্যের স্বীকার ও, কারন একটাই ওর পিতার রোজগার নেই বললেই চলে। 


মাদ্রাসার গণিত শিক্ষক আমার স্বামী, শিক্ষকতার দশ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে তবুও বেতন হয়নাই। 

উপর মহলে প্রায় সবাই ছুটোছুটি করে, বড় বড় এমপি মন্ত্রী দের সুপারিশ নেয়, নিজেদের জমাকৃত সবকিছু ফুরিয়ে ফেলে তাদের পিছনে তবুও কোনো সুফল পাওয়া যায় না। এতকিছুর পরও কেউ আশা ছাড়ে না, 

মাদ্রাসার সকল শিক্ষকের বিশ্বাস একদিন তাদের বেতনের বিল পাশ হবে।  

অনেকবার ছেলের বাবাকে বলেছি এ চাকরি ছেড়ে দিয়ে নতুন কিছু করার জন্য, কিন্তু ও নাছোড়বান্দা চাকরি সে ছাড়বে না কখনও।


আমি নিজে সদ্য ডিগ্রি পাশ করে বসে আছি, ঠিক বসে আছি বললে ভুল হবে এই যৌথ পরিবারের ঘানি টানছি চার বছর ধরে। 

আমার শ্বশুর শাশুড়ীর চার ছেলে এক মেয়ে, আমার স্বামী মাহিম তৃতীয় ছেলে, ছোট দেবর পড়াশোনা করছে বাইরে থেকে। 

বড় ভাসুর এর বিরাট ব্যবসা ভাবি প্রাইমারি'র শিক্ষিকা, ছোট ভাসুর ও ভাবি দু'জনেই কলেজের লেকচারার, আমি যে কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করলাম সেখানকার। বাবা মা বেঁচে আছেন বলে সকলে একত্রে আছেন শুনেছি। 

সকাল দশটার আগে বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়, যে যার যার কর্মস্থলে ছুটে। সকালের খাবার হিসেবে রোজ খিচুড়ি করা হয় তার সাথে কখনও ডিম কখনও মাংস খাওয়া হয়। ভাবিরা উঠে আমাকে সামান্য সাহায্য করে ঘরে ছুটেন তৈরি হতে। 

আমি না থাকাতে শুনেছি তিন বউ শাশুড়ী মিলে সব কাজ করতো। আর এখন প্রায় সব কাজ আমাকে একা হাতে করতে হয়। সুযোগ পেয়ে আমাকে সকলে মিলে এভাবে খাঁটিয়ে নিচ্ছে। মুখ বন্ধ করে সবার সব ভালোমন্দ কথা সহ্য করে সকলের খেয়াল রাখি, 

বিনিময়ে যদি আমার ছেলেটা একটু ভালোমন্দ খেতেই না পারে, ভালো পরিবেশ এ বড় হয়, আমাদের স্বামী-স্ত্রীর কথা বাদই দিলাম। 

থাকতে ইচ্ছে করছে না আর এই সংসারে আমার, আলাদা হয়ে যদি ডাল-ভাত খাই নিজের করে তবুও আলহামদুলিল্লাহ।

 রোজ শাশুড়ির বকাঝকা আর ভালো লাগছে না আমার, মাহিম কে বললে বলে ভাবি ভাইকে বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়ে মা তোমাকে তুচ্ছ করছে। এতে তুমি কিছু মনে করো না লক্ষ্মীটি, মনে করো আমরা একরকম পরাশ্রয়ী। তাই তাদের মন যুগিয়ে চলতে হবে। আমার আর কিছু বলার থাকে না, মা ছেলের অভিভাবক যে সেই যদি চুপ করে থাকে তাহলে আর কি!  

আজ মুরগি রান্না করলাম, মা এসে বাটি সাজাচ্ছে। সকলের আলাদা আলাদা বাটিতে তরকারি তুলে রাখার নিয়ম এ বাড়িতে। ছেলের বাটিটা অপরাধীর মতো মায়ের সামনে ধরে বললাম মা আজ আমাদের তিনজনের জন্য শুধু মুরগির একটা কলিজা দেন, বাকিসব মাংস আর সবার জন্য রাখুন। ছোট বাচ্চাদের মুরগির কলিজা খেতে হয় ছোট থেকে শুনে এসেছি,কলিজা অনেক পুষ্টিকর খাদ্য যা আপনার নাতির এ-সময় প্রয়োজন। 


-- তা, তুমি কতগুলো মুরগির কলিজা খেয়ে মানুষ হয়েছো বউমা!  

-- আমার ছোট কালের কথা মনে নেই মা,ছোট ভাইয়ের জন্মের পর মা'কে হারিয়ে এতিম আমরা দুই ভাইবোন মামার বাড়িতে কষ্টকরে মানুষ হয়েছি। 

-- খেয়েছোতো ওই তোমার মামীর কথার ঝাড়ি আর ঝাড়ুর বারি। 

-- আমি না-হয় মামীর বারি আর ঝাড়ি খেয়ে মানুষ, কিন্তু আপনার নাতিটা কি খেয়ে মানুষ হচ্ছে বলতে পারেন। 


-- দিন দিন তোমার মুখ বেড়ে যাচ্ছে বউমা, তোমার আচরনের জন্য বাড়িতে সালিশ বসাতে চাই না আমি। 


-- মা, নিজের বিবেককে একবার প্রশ্ন করুন ভালো করে আমি অন্যায় কিছু বলি নাই। বাকি চারটা বাচ্চার মতো সে-ও আপনার পরিবারের সন্তান। 

মানছি আমার স্বামী আমি পরিবারে টাকা দিতে পারি না, কিন্তু তার জন্য তো আমি দিন-রাত কাজের মানুষের মতো খেটে মরছি। তবুও কেনো আমার সন্তান একটা মুরগির কলিজা খেতে পারবে না, কেনো সে তার এই বাড়ন্ত বয়সে ভালো পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হবে!  


 গোসলের পর রোজ কাপড় খুলে রাখেন সেগুলো তো আমি ধুয়ে দিই কোনোদিনও টু শব্দ করি না যে আমার কষ্ট হয় এত কাজ করতে।

 আপনার মাথায় তেল দেওয়া নিয়ম করে ঔষধ খাওয়ানো সব কাজই তো আমি একা হাতে করি। তবুও আপনার স্নেহ পেলাম না কখনও তা কি শুধু মাস শেষ এ আপনার হাতে হাজার টাকা গুঁজে দিতে পারি না বলে। 

ঠাস করে একটা চড় এসে পড়লো আমার গালে, চিৎকার করে উঠে বললাম আল্লাহ এর বিচার করবে নিশ্চয়। শ্বশুর ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে মা কে একটা কথাই বললেন বিবি তুমি রত্ন চিনলা না। যাও মা ভিতরে যাও, আর এ ঘটনা আমরা তিনজন ছাড়া অন্য কেউ যেনো না জানে। তোমার শাশুড়ীর হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি তোমার কাছে। 


মা কয়েকদিন আমাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেও পারলো না, কারন আমাকে ওনার প্রয়োজন। আমিও সব ভুলে নিজের দায়িত্ব পালন করছি। 

মাহিম কে সেদিনের ঘটনা বিস্তারিত বললে মন খারাপ করে সে, নিজের সন্তানের মুখ চেয়ে বলে বাবা আল্লাহ আছেন আমাদের সাথে। 

ফজরের নামাজ পড়ে একটু শুইছি, বড় ভাসুর ডাকছে 

অর্ক'র মা তাড়াতাড়ি বাহিরে আসো। 

ভাবলাম কি-না কি হয়েছে, দ্রুত উঠে বাহিরে গিয়ে দেখি অনেক কয় প্রকারের দেশি মাছ এনেছে যা পরিস্কার করা কষ্টকর। এত মাছ দেখে মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো আমার। বললাম ভাইজান এতগুলো আমি একলা পরিস্কার করতে পারব না।

একা কেনো বাকি সদস্য রাও আসতেছে। 

এই বলে তিনি ভিতরে সবাই কে ডাকতে গেলেন। ভাবিরা হাত লাগালেন মাছে কিন্তু তিন ভাগের এক ভাগ বাছার পর নিজেদের কর্মস্থলের কথা বলে উঠে পড়লেন। 

অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম বাজে ঘড়িতে সাতটা আজ এত তাড়া ওনাদের। 


হঠাৎ বাবা এসে মাছ ঘসতে শুরু করলেন। 

সর্বনাশ! বাবা একি করছেন আপনি।

আমি তো আর বটি তে মাছ কুটতে পারব না, মনে হলো এই কাজটা করতে পারবো তাই আমার মা কে সাহায্য করছি। 

আমি লজ্জা পেয়ে বাবা কে বললাম বাবা আপনি উঠে পড়ুন, কেউ দেখলে কি ভাববে বলুন তো। 

দেখতে দাও মা তবুও যদি কারও চোখের লজ্জা হয়। 


অর্ধেক মাছ পরিস্কার করার পর বাবা বললো আর মাছ কাটতে হবে না তোমায়। আজ দু'জন কাজের মহিলা আসবে কাল যে তোমার আপা আর আমার মেয়ে আসছে এ বাড়িতে। 

আপা আসছে এ কথা শুনে মনটা খুশিতে ভরে গেলো। 


আপা অনেক ভালো মানুষ, আমাকে অনেক স্নেহ করেন। তিন বউয়ের মধ্যে আমাকে বেশি খাতির করার কারনে ভাবিরা মুখ অন্ধকার করে থাকেন আপা আসলে। আমি একা হাতে রান্না করি বলে আপা আমাকে বেশি পছন্দ করেন সেই সাথে আমার হাতের রান্নার প্রসংশা সবসময় ওনার মুখে থাকে। 

আপা আমাকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এনে দেয়। এত নিষেধ করি আমরা তবুও। আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে, আপা যতবার এ বাড়িতে এসেছে ততবারই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে বাড়িতে ঝগড়াঝাটি ঝামেলা লাগে। 

আল্লাহর কাছে চাই আপা যেনো ভালোয় ভালোয় এসে ফিরে যেতে পারেন। 

বিকেলে সকলের জন্য চা করলাম, সবাই চা খাচ্ছে আর গল্প করছে। এরমধ্যে বাবা গলা উঁচু করে কিছু বলতে চাইলেন সকলকে। ওনার এক কথা এবার যেনো আপা আসায় বাড়িতে কোনো ঝামেলা না হয় এবং আমার সাথে ভাবিরাও যেনো যতটুকু সম্ভব কাজ করে, এবং দু'জন সাহায্যকারী মহিলা তো থাকবেন। 

বাবার মুখের কথা শেষ হওয়া মাত্র, এর পরীক্ষার ডিউটি ওর মিটিং শুরু হয়ে গেলো৷ সেই সাথে মাহিম ও আমাকে অপমান করতে ছাড়লো না কেউ পরের বোঝা বলে। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, কি বলা উচিত এখানে আমার খুঁজে পাচ্ছিলাম না। 

এমন সময় আমার ভাই ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এসে বলল আপু ওরা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, এতক্ষণে চোখে পড়লো ভাইয়ের মাথা থেকে রক্ত পড়ছে। 

 

তুহিন, কে এভাবে মারলো তোকে।

 মুরাদ মেরেছে আপু, সাথে মামীও যুক্ত ছিলেন। মুরাদ মামার বড় ছেলে। 

ওসব কথা পরে হবে অনিতা(আমি), তুহিন কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, এই বলে বড় ভাসুর মোটরসাইকেল বের করে তুহিন এর সাথে মাহিম কেও নিয়ে ডাক্তার খানায় গেলো। 


আমি হাহুতাশ করতে লাগলাম, বাবা টেনশন করতে নিষেধ করলেন। বসার ঘরে সবকিছু ফেলে রেখে অর্ক কে নিয়ে নিজের ঘরে চুপ করে রইলাম। 

একে তো আমরা তিনজন এ পরিবারের বোঝা, এরমধ্যে তুহিন এলো। ও কোথায় বা যাবে আর, তাই দিশেহারা হয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছে। একটাই ভাই আমার, এ অবস্থায় ওকে আর মামার বাড়িতে রাখা চলবে না। সংসারে কেউ বাড়তি ঝামেলা নিতে চায় না, মামীও এর ব্যতিক্রম নয়। 


আমি ভাবছি অন্য কথা অনি শুনছো, মাহিমের কথায় মুখ চেয়ে তাকালাম ওর দিকে। 

কি ভাবছো, আমাকে বলতে পারো, 

অবশ্য আমার বিশ্বাস আমি যা ভাবছি তুমিও তাই ভাবছো। 


তুহিনের কি ব্যবস্থা করবো বলো তো, সামনে ওর এসএসসি পরীক্ষা। 

অত ভেবো না, মামা হয়তো নিতে আসবে ওঁকে। কয়েকদিন এখানে থেকে না-হয় আবার যাবে মামার বাড়িতে। 


আচ্ছা তাই যেনো হয়। 


রাতের খাবার আগেই রান্না করে রেখেছি, সবাই কে খেতে ডাকতে গিয়ে দেখলাম বিকেলের নাস্তা খাওয়ার এঁটো কাপ পিরিচ জড় পদার্থের মত পরে আছে টেবিলে। 

আফসোস হলো হায়রে মানুষ! কেউ কি এসবও একটু গুটিয়েও রাখতে পারে নাই আজ। 

রাতের খাবার শেষ এ যে যার যার ঘরে ঘুমাতে গেলো। 

দেবর এর ঘরে তুহিনের থাকার ব্যবস্থা হলো। ওর কপালের ওপরে দুটো সেলাই করা হয়েছে, ডাক্তার কিছু ঔষধ দিয়েছে। 


সারাদিন এত কাজ করে ক্লান্ত কিন্তু চোখে ঘুম আসছে না, এবার যদি আমাকে ভাইটার দায়িত্ব নিতে হয়, কিভাবে কি করব আমি। কাল আবার আপা আসবে বাড়িতে , সকালে উঠে কাজ শুরু করতে হবে। 

ঘুমাতে যাব এমন সময় তুহিন কাঁদতে কাঁদতে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আপু আপু বলে ডাকছে। আমার কলিজাটা টা কেঁপে উঠলো এত রাতে আবার ওর নতুন কোনো বিপদ হলো নাকি। আমি উঠার আগে মাহিম দরজা খুলে তুহিন কে ভিতরে নিয়ে আসলো। 


তুহিন আমাকে জড়িয়ে ধরে,

-- আপু ওই বাড়িতে আমাকে আর পাঠাস না আপু। 

তুই আসার পর তোর ভাগের সমস্ত কাজ আমাকে করতে হয়। একটু কমবেশি হলে মামী কানমলা দিতেন৷ কিছুদিন থেকে মারধর করতেছে তাই তোর কাছে ছুটে এসেছি। 

আমাকে তোর কাছে একটু থাকতে দে আপু, আগে যেমন ভাত ভাগ করে খেতাম এখনও তেমন খাবো। দিবি না তোর ভাগ থেকে ভাত খেতে আমায়!

ডুকরে কেঁদে উঠলাম দু'জনে। 

মাহিম তুহিন কে শান্ত করে বলল আজ আমাদের সাথে ঘুমাও তুমি, আর অনি চোখ মুছো এখন থেকে তুহিন আমাদের সাথে থাকবে। 

পরে যা হয় হবে দেখা যাবে, এখন অনেক রাত ঘুমিয়ে পড়ো।  

আমি শুধু একটা কথাই ভাবছি তুহিনের দ্বারা মামা-মামী কিভাবে আমার কাজগুলো করিয়ে নিতো, ও একটা কিশোর ছেলে তাকে দিয়ে মেয়ে মানুষের তরকারি কুটা, বাসন মাজা, ঘর ঝাড়ু মুছা, মসলা বাটা, কাপড় ধোঁয়া কিভাবে সম্ভব এতকিছু, সামান্য কিছু করিয়ে নিলে পারত। যাইহোক ওনারা আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এটাই অনেক, শুকরিয়া এর জন্য। 

আপা আসার পর বাড়িতে খুশির আমেজ, কয়েকদিন সবাই মিলে হৈচৈ আনন্দ করে কেটে গেলো। 

আপা তুহিনের ব্যাপারে সবকিছু শুনে সবাইকে বললেন তুহিনের দায়িত্ব আপা নিতে চান। 

কিন্তু তুহিনের এসএসসি পরীক্ষা জন্য এখন সে যেতে পারবে না, পরীক্ষার পর যাবে এবং আপার ছেলেকে পড়াবে ও ক্লাস থ্রি তে পড়ে। দুলাভাই যাওয়ার সময় তুহিনকে বলে গেলো পড়াশোনা ভালো করে করতে হবে, জীবনে অনেক বড় হতে হবে পৃথিবীটা বড্ড স্বার্থপর, তাই তোমাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে ভাই। 

অনুপ্রেরণা মূলক কথা শুনে তুহিন দুলাভাই এর পা ছুঁয়ে সালাম করে।


আপা দুলাভাই চলে গেছে। মামা আসে নাই তুহিন কে নিয়ে যেতে, ওর সমস্ত বই কাপড় পাঠিয়ে দিয়েছে একটা লোকের দ্বারায়। 


আগের মতোই দিন যাচ্ছে আমার কাজ করতে করতে গালি শুনতে,

 তবে বদলায়ছে একটা জিনিস, আগে রান্না করতাম গ্যাসের চুলায় এখন করতে হয় লাকড়ি দিয়ে মাটির চুলায় এই কাজটা বেশ কষ্টকর। 

গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে তাই মাসে দুটা সিলিন্ডার কেনা সম্ভব নয় এবং পরিবারে খাওয়ার মুখ বেড়েছে, সেজন্য হিসেব করে চলতে হবে। 

শাশুড়ী মায়ের মুখ থেকে কথা গুলো শুনে বুঝতে পারলাম তুহিনের জন্য এতকিছু।

তাই বলে এতদিন থেকে যেভাবে রান্না করে আসছি তা হঠাৎ পরিবর্তন করতে আমার বেশ কষ্ট হয়েছে, আগুনের ভীষণ তাপে গরম লাগে খুব আমার। 

যাইহোক বিপদ আমার নিজের, এমন কষ্ট সহ্য করতেই হবে। 


সবচেয়ে আশ্চর্য কর বিষয় হচ্ছে, ইদানীং আর কোনো ভাবিও আমাকে এতটুকু সাহায্য করে না কাজে। 

ঘুম থেকে উঠে একা হাতে সকলের জন্য খাবার তৈরি, তারপর সমস্ত বাসন পরিস্কার ঘরদোর ঝাঁড়া মুছা, তরকারি কুটা বাছা রান্না, আবার নিয়ম করে পরিস্কার করা আবার রাতের জন্য রান্না করা। তারমধ্যে আমার ছেলেকে দেখতে হয়, শ্বশুর শাশুড়ীর তো এক্সট্রা কাজ আছেই। 

একলা আর পেরে উঠছি না, 

আমার এত কষ্ট দেখে তুহিন কিছু কাজে হাত লাগায়, নিষেধ করি ওর সামনে পরীক্ষা তবুও বলে আমি তো সবসময় পড়াশোনা করি আপু। তোকে এইটুকু সাহায্য করলে কিচ্ছু ক্ষতি হবে না আমার। 

এভাবে আর চলা সম্ভব নয়, আর্জি নিয়ে শাশুড়ীর কাছে গেলাম একটা কাজের মহিলা ঠিক করে দেওয়ার জন্য। 

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো উনি, রাগে গজগজ করে বলতে লাগলো টাকা কি তোমার বাপে দিয়ে যাবে! 

আমার আর বলার কিছু থাকলো না। 

আমার এত পরিশ্রম দেখে মাহিম নিজে শুধু বাসন পরিস্কার ও ঘর মোছবার জন্য একজন মহিলা ঠিক করলো। 

তখন সবাই বলাবলি করছিল, সংসারে যে একটা টাকা দিতে পারে না সে আবার নিজের বউয়ের জন্য কাজের লোক রেখেছে! তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সুরে। 

মুখ বুঁজে সব সহ্য করে সকলের জন্য সমান ভাবে কাজ করে যাই, তবুও পান থেকে চুন খসলেই গালমন্দ। 


এ বাড়িতে গরুর মাংস কম রান্না করা হয়, আজ গরুর মাংস রান্না হবে। গরুর মাংস আমার ভীষণ পছন্দের। 

শাশুড়ী মা গুনে গুনে ৪৭ পিচ গরুর মাংস দিলেন আমায় রান্না করতে। আমি হতবাক, 

-- মা, মাংস যে আজ হঠাৎ গুনে রান্না করতে দিলেন! দোকানে কি এখন গুনে মাংস বিক্রি করে নাকি। 

-- মাংস কেজি ধরা বিক্রি হয় সেটাও জানো না, বাড়িতে তো বাড়তি লোকের অভাব নেই বলা তো যায় না রান্না করতে করতে মাংস না অর্ধেক হয়ে যায়। 


-- রান্না আমি একা হাতে করি, আপনি কি কখনও কম তরকারি পেয়েছিলেন যে আজ এমন নিকৃষ্ট মনা কাজটা করতে হলো। 

আর শুনেন, আমি কখনও রান্নার সময় খাবার তুলে খাই না কিংবা নিজেদের জন্য তুলেও রাখি না। 

এত অবিশ্বাস, অপমানের পর আমি আর মাংস রান্না করতে পারব না। 


-- আচ্ছা বেশ, আজ তাহলে তোমাদের খাওয়া বন্ধ। আমিই রান্না করব নিজ হাতে।

 রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম, 

সত্যি সেদিন খাওয়া হয়নি আমাদের, কেউ ডাকে নি খেতে বাবা গিয়েছিলো আপার বাসায়। 


মাহিম সেদিনের ব্যবহারে অনেক কষ্ট পেয়েছে, বলছে এভাবে আমরা আর কতদিন সহ্য করব অনি বলতে পারো, কষ্ট তো সব সহ্য করছো তুমি। ভাবছি আমার নিজেকেই কিছু একটা করতে হবে এভাবে নিজের স্ত্রীর কষ্ট আমিও সহ্য করতে পারছি না। 


সব কষ্ট সহ্য করে সব কাজ করছি, মুখের মধ্যে ফেভিকল লাগিয়ে এমন ভাবে সব সহ্য করছি।

 তবে অত্যাচারের মাত্রা বেড়েছে আমাকে কাজে সাহায্যকারী মহিলা টা হয়ে গেছে ভাবিদের, মহিলাটাকে ওনারা আমার কাছে আসতে দেয় না সকালে ওনারা চলে যাওয়ার পর শাশুড়ীর নিজের সাথে রাখে। 

আমার পরিশ্রম কমলো না। মাহিম ভীষণ রেগে গেছে, আমার পরিশ্রম কমানোর জন্য ও কাজের মহিলা ঠিক করলো আর সে কিনা আমাকেই সাহায্য করতে পারে না।


তুহিনের পরীক্ষা শেষ দুলাভাই এসে নিয়ে গেছে ওঁকে। 

এখন বাড়িতে মাছ মাংস রান্না হলেও আমাদের পাতে পরে না। এতদিন আমার ভাই খেয়েছে তাই, যখন তার খরচ টা পুষিয়ে যাবে তখন আবার আমরা ভালো মন্দ খেতে পারব।

 শাশুড়ী আবার একদিন আমার গায়ে হাত তুলল সকলের সামনে। আমার জন্য নাকি ওনার পরিবারে ফাটল ধরেছে। কালনাগিনী আমি, তাই ওনার বড় ছেলে পরিবার সবকিছু নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে উঠে যাবে আর মেজ ছেলে পরিবার নিয়ে শহরের বাসায় থাকবে। 


-- এর পরেও কি তুমি চুপ করে থাকবে মাহিম! 

আমার মা অন্যায়কারী ওনাকে কোনো শাস্তি আমি দিতে পারবো না ঠিকই অনি,আল্লাহ ওনাকে সঠিক বুঝ দান করুক। কিন্তু এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারব তোমাকে ও অর্ক কে নিয়ে, যাতে আর অপমানিত হতে না হয় আমাদের।  


পরদিনই আমরা একেবারে বিভাগীয় শহর রাজশাহী তে চলে আসলাম। 

গল্পের বাকি অংশ ২য় পর্বে........ 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ