গল্পঃ- কুয়াশার মতো পর্ব -১

 - মা বললো " তোর স্বামীর জন্য রোজরোজ ভাত রান্না করি নাকি? প্রতিদিন রাতে এসে বসে থাকে, লজ্জা সরম কিছু নাই নাকি? 

- সে কি ভাত চাইছে মা? 

- না চাইলে ও তো আমরা বুঝি, তাছাড়া ড্রইং রুমে বসে থাকলে ডাইনিং রুমে বসে কীভাবে খাবো আমরা? 

- আমার সঙ্গে যেভাবে কড়া কথা বলো সেভাবে ওর সঙ্গে বলতে পারো না মা? আমি তো পছন্দ করে বিয়ে করিনি, তোমাদের পছন্দের ছেলে। 

- আমার হয়েছে যত জ্বালা, তোর বাবা নিজের রুমে বসে বকবক করে। সে নিজেও কিছু বলতে পারে, কিন্তু তা না করে সবকিছু আমার উপর। 

- সত্যি করে বলো তো মা, তুমি আর বাবা আমাকে কি আর ওর সঙ্গে সংসার করতে দেবে না? 

- পাগল নাকি তুই? তোর বাবা ডিভোর্সের সকল ব্যবস্থা করতে বলেছে উকিলকে। 

- তাহলে কি আমি ওর সামনে গিয়ে আজকে সরাসরি বলে দেবো যে আর কোনদিন আমাদের বাড়ি যেন না আসে। তার ডিভোর্স পেপার সে বাসায় পেয়ে যাবে, বলবো মা? 

- পারবি শাকিলা? সেটাই বলে দে, প্রতিদিন আর সহ্য করতে পারি না। 

- ঠিক আছে যাচ্ছি আমি। 

ড্রইং রুমে বসে বসে সকাল বেলার পুরনো পত্রিকা খুলে পড়ছে সাজ্জাদ, আমার স্বামী। আমি তার সামনে যেতেই সে দাঁড়িয়ে গেল, বাসা থেকে চলে আসার পড় এটাই আমাদের প্রথম দেখা। সে ঠিক প্রতিদিন আসে কিন্তু আমি কোনদিনই সামনে আসি না। 

সেই চেহারা নেই, চোখ গুলো কেমন কোটরে ঢুকে গেছে, সম্পুর্ণ পোশাক যেন অন্যরকম। এভাবে এর আগে কখনো দেখিনি ওকে, 

- আমি বসতে বসতে বললাম, কেমন আছো? 

- ভালো। 

- চা-নাস্তা করা হয়েছে? 

- শুধু চা দিয়েছিল। 

- তো বাসায় যাবে কখন? প্রতিদিন এতো রাত করে বসে থাকো, বিরক্ত লাগে না? 


- না, আর তোমার জন্য তো অপেক্ষা করি। তুমি সামনে এলে তো বসে থাকতে হতো না, আমার সঙ্গে তুমি কথা বলো না কেন? 

- কথা বলতে ইচ্ছে করে না তাই বলি না। 

- তোমার নাম্বার বন্ধ করে রাখছো। 

- হ্যাঁ, তাহলে বুঝতেই পারছ তোমার সঙ্গে কথা বলার কোন ইচ্ছে নেই বলে তো বন্ধ। 

- আমার ভুল হয়ে গেছে। 

- কিসের ভুল সাজ্জাদ? আজব।

- তাহলে আমাকে রেখে কেন এখানে আছো, তুমি কি আমার সঙ্গে থাকবে না শাকিলা? 

- না সাজ্জাদ, তুমি তো জানো সরাসরি কথা বলা আমার বেশ পছন্দের। আজও তোমার সামনে আসার কোন ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু তুমি প্রতিদিন রাতে এসে বসে থাকো, বিশ্রী লাগে। 

- আমার কি করা উচিৎ? 

- তুমি কি জানো হয়তো মা-বাবা সবাই তোমার প্রতি খুব বিরক্ত? 

- হ্যাঁ জানি, কিন্তু তুমি তো আমাকে পছন্দ করো ভালোবাসো, তাই আসি। 

- যদি বলি আমিও তোমার প্রতি খুব বিরক্ত তবে কি আর আসবে না? 

- মনে হয় আসবো না, কিন্তু আমি জানি তোমার কোনদিনই বিরক্ত আসবে না। 

- তোমার জানায় ভুল আছে, আমি তোমাকে এখন খুবই বিরক্ত মনে করি। নাহলে অনেক আগেই তোমার সঙ্গে চলে যেতাম, নাহলে একা একা বাসায় যেতাম। 

- চুপচাপ। 

- একটা কথা বলবো? 

- হুম বলো। 

- তুমি আর এসো না, বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে বাবা আমাদের বিষয় কথা বলেছেন। তিনি মনে হয় শীঘ্রই ডিভোর্সের সকল কাগজপত্র নিয়ে আসবে। 

- ওহ্, তোমার ইচ্ছেতে? 

- হ্যাঁ। 

- আমি কি আমার অপরাধ জানতে পারি? 

- তোমার কোন অপরাধ নেই, তুমি অতিরিক্ত ভালো মানুষ। আর সেটাই তোমার সমস্যা, তবে বাবার সমস্যা হচ্ছে তোমার কারণে নাকি বাবার অফিসে একটা সমস্যা হয়েছে। 


- হ্যাঁ কিছুটা, আমাদের একটা কাজ তোমার বাবার অফিসের করার কথা ছিল। তাদের কাজের মান ভালো না তাই আমি কাজটা অন্য কোম্পানি কে দিতে বলেছি আমাদের স্যার কে। 

- তোমার কি উচিৎ ছিল না বাবার কথা শোনা? 

- কাজের সময় কাজ, বাসায় এলে শশুর জামাই সম্পর্ক, তাই আগে কাজ। 

- এটাই সমস্যা, যাইহোক আমি তোমার কাজের প্রতি শ্রদ্ধা করি। 

- তাহলে আমার সঙ্গে চলো। 

- সেটা সম্ভব না, আগেই বলছি। বাবার যেমন সমস্যা তার অফিসে, আমারও তেমন কিছু সমস্যা আছে বাসাতে। তবে বলতে চাই না। 

- আচ্ছা ঠিক আছে। 

- তুমি এখন চলে যাও, আর কোনদিন আসার দরকার নেই। 

- ভাত খেয়ে যাই? 

- না, বাসায় গিয়ে খেও, তোমার জন্য এখানে অতিরিক্ত রান্না করা হয় না। 

- তোমার জন্য তো হয়? সেখান থেকে নাহয় একটু খেতে দিলে। 

- সাজ্জাদ...? অদ্ভুত কথাবার্তা সব। 

- আচ্ছা সরি, এমনিতেই ফাজলামো করেছি। তো ভালো থেকো সবসময়। 

সাজ্জাদ উঠে দাঁড়িয়ে গেল, দরজা খুলে একাই বের হয়ে গেল। আমি দরজা বন্ধ করার জন্য এগিয়ে গেলাম, পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম, 

- বাসায় রান্না করো নাকি হোটেলে খাও? 

- সাজ্জাদ ঘুরে তাকাল, বলল, কোনটাই না। হোটেলের খাবার সহ্য হয় না, আর বাসাতে কেন যেন রান্না করতে ইচ্ছে করে না। সারাদিন শুকনো খাবার খেয়ে চলে যায়, আর রাতে তো তোমাদের বাসায় খেতাম। আজ থেকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। 

সাজ্জাদ সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেল, আমি দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে চলে গেলাম। ঘন্টা খানিক পড়ে বাবার চিৎকারে রুম থেকে বের হলাম, বাবা বলল,

- ইচ্ছে করেই চাবি ফেলে গেছে, চাবি নেবার বাহানা ধরে আবার আসবে। 

- বললাম, কি হয়েছে বাবা? 

- সাজ্জাদ বাসার চাবি ফেলে গেছে মনে হয়। 

- তাহলে চিৎকার করো কেন? এলে আবার দিয়ে দেবে তাতেই তো হয়ে যায়। 

- কোন দরকার নেই, চাবি নিচে গিয়ে দারোয়ান এর কাছে রেখে আসবো। সে এলে দারোয়ান তাকে চাবি দিয়ে দেবে। 


আমি চুপচাপ রুমে চলে গেলাম, বাবা চাবি নিয়ে চলে গেছে নিচে। অন্ধকার রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে জীবনের হিসাব মেলাতে লাগলাম। 

রাত দুইটা। 

দরজা খুলে নিচে গেলাম, দারোয়ান কাকা বসে বসে ঝিমাচ্ছে। আমি তাকে ডাক দিতেই তিনি ধড়ফড়িয়ে উঠলেন। 

- কে কে কে? 

- কাকা আমি শাকিলা। 

- ওহ্ তুমি? 

- কাকা আমার হাসবেন্ড এসেছিল? 

- না আসেনি এখনো। 

- যদি আসে তাহলে তাকে চাবি দেবার সময় বলবেন আগামীকাল সকালে আমি বাসায় যাবো। সে যেন সকাল বেলা আমাকে নিতে আসে, বাসায় যেতে হবে না, রাস্তায় দাঁড়ালে হবে। 

- আচ্ছা। 

সকাল বেলা মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে শুনি বাড়ির দারোয়ান কাকা আমাকে ডাকছে। আমি মনে মনে ভাবলাম যে সাজ্জাদ হয়তো চলে এসেছে আমাকে নিতে। নিশ্চয়ই সে নিচে দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য, কাপড়চোপড় টুকটাক রাতেই গুছিয়ে রেখেছি। কোনরকমে হাতমুখ ধুয়ে ব্যাগ নিয়ে বের হলাম, মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। 

পিছন থেকে বারবার ডাকছে আমি শুধু বললাম, নিজের সিদ্ধান্তটা নিজে একটু নেবো। 

নিচে এসে সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে, সাজ্জাদ আসেনি। ভোরবেলা এসে একটা চিঠি রেখে গেছে, দারোয়ান কাকা সেটাই দেবার জন্য আমার খোঁজ করছেন। 

তেমন কিছু লেখা নেই, শুধু লেখা আছেঃ- 

" অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল ব্যস্ত শহর ছেড়ে কোন এক নদীর চরে কিংবা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবো। আজ সেই ইচ্ছে পুরণ করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, বাসার সবকিছু তোমার নিজের হাতে গড়া। সেগুলো তুমি গ্রহণ করে নিও, একটাই আফসোস ' তুমি কেন আমার সঙ্গে এমনটা করলে সেই উত্তরটা জানতে পারি নাই। "



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ