খুলাফায়ে রাশেদিনের পরিচয় || খুলাফায়ে রাশেদিন ১ম পর্ব

 


খুলাফায়ে রাশেদিনের পরিচয় : খলিফা শব্দের অর্থ প্রতিনিধি পবিত্র কুরআনের ভাষায় প্রত্যেক মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা । কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) এর মৃত্যুর পর মুসলিম উম্মাহর নেতাকে খলিফা বলা হয় । এ খিলাফত হচ্ছে মিনহাজুন্ নবুওয়্যাত বা নবুয়াতের পদ্ধতি । ব্যাপকার্থে খিলাফত হচ্ছে ইসলামের ধর্মীয় , সামাজিক , রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান । ইসলামের সরকার পদ্ধতি খিলাফত বলা হয় । ইসলামি জীবন ব্যবস্থার পরিপূর্ণ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন হয়েছিল খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে । আর তাঁদের ত্রিশ বছরের ( ৬৩২-৬৬১ খ্রিঃ ) খিলাফত কালই ছিল ইসলামি শাসন ব্যবস্থার আদর্শ সোনালী যুগ । মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম হযরত আদম ( আ . ) কে পৃথিবীর খিলাফত দান করেছিলেন । তাঁর সন্তানদের মধ্যেও এ খিলাফত পুরুষানুক্রমে চলতে থাকে- যা বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করেছে ।মুসলমানদের জনমতের ভিত্তিতে তাদের যে নেতা নির্বাচিত হয় , তাঁকে ইমাম বা খলিফা বলে ।

 কারণ তিনি পৃথিবীতে আল্লাহর নবির প্রতিনিধি এবং মুসলমানদের নেতা । হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) - এর ইন্তেকালের পর যে চারজন বিশিষ্ট সাহাবি আল্লাহ ও রসুলের নির্দেশিত পদ্ধতি অনুযায়ী ইসলামি রাষ্ট্রের শাসন কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে গেছেন , তাঁরা খোলাফায়ে রাশেদীন বা সত্যপথগামী খলিফা নামে পরিচিত । তাঁরা হলেন

 ১. হযরত আবু বকর সিদ্দিক ( রা . ) 

২. হযরত উমর ফারুক ( রা . ) 

৩. হযরত উসমান ( রা . )  

৪. হযরত আলী ( রা . )

 মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এই খিলাফতের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে- “ তোমাদের উপর আমার আদর্শের অনুসরণ ও খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শের অনুসরণ অত্যাবশ্যক । ” খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবন ও তাঁদের ত্রিশ বছরের খিলাফত যুগের নজিরবিহীন কৃতিত্বের প্রমাণ নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ থেকে অনুমান করা যায় । 

প্রশাসন : খলিফা ছিলেন প্রশাসনিক সর্বোচ্চ কর্মকর্তা । শূরা বা উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ করে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন । ইবনে খালদুনের মতে , “ খিলাফত হচ্ছে এমন প্রতিষ্ঠান যা মহানবি ( স ) -এর মিশনের প্রতিনিধিত্ব করে । সে কারণে খলিফার প্রধান কর্তব্য হচ্ছে ধর্মের রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং সাধারণভাবে রাষ্ট্রনীতি সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা । 

নির্বাচন পদ্ধতি : খোলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন পদ্ধতি ছিল গণতান্ত্রিক । খোলাফায়ে রাশেদীনের খলিফাগণ যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হতেন । প্রাথমিক পর্যায়ে খলিফাদেরকে তিনটি উপাধিতে আখ্যায়িত করা হতো । তা হলো খলিফা , ইমাম ও আমিরুল মু'মিনীন । আল মাওয়ারদীর মতে , খলিফা পদের জন্য প্রাথমিক ৭ টি গুণ বা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে । তাঁকে কুরাইশ বংশোদ্ভুত , মুসলমান , পুরুষ , প্রাপ্ত বয়স্ক , চরিত্রবান , শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং শাসন কার্য পরিচালনার উপযোগী , কুরআন সুন্নার জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে ।

 তদুপরি তাঁকে মুসলিম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য উপযুক্ত সাহসের অধিকারী হতে হবে । এ যুগের নির্বাচন পদ্ধতি ছিল দুটো । একটি সরাসরি নির্বাচন যেমন হযরত আবু বকর ( রা . ) প্রথম খলিফা হিসেবে জনগণের সরাসরি সমর্থনে নির্বাচিত হয়েছিলেন । দ্বিতীয় হলো নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক মনোয়ন দান । উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন , শিক্ষিত , ন্যায়বান , আদর্শবান কয়েকজন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে খলিফাগণ মৃত্যুর পূর্বে একটি নির্বাচকমন্ডলী গঠন করতেন । খলিফার মৃত্যুর পর তাঁরা পরবর্তী যোগ্য লোকদের মধ্য থেকে খলিফা নির্বাচন করতেন । এ পদ্ধতিতে হযরত উমর ( রা . ) , হযরত উসমান ( রা . ) ও হযরত আলী ( রা ) খলিফা নির্বাচিত হয়েছিলেন ।

 আদর্শবান ও বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ একজন খোদাভীরু , সৎ , যোগ্য , পদের প্রতি লোভহীন , সাহসী , কর্মঠ , সংযমী , উদ্ভাবনীয় ও বিশ্লেষণী শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিকে খলিফা হিসবে নিযুক্ত করতেন । সকলে তাঁর হাতে হাত রেখে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করতেন । প্রশাসক বা কোন দায়িত্বশীল নিয়োগের ক্ষেত্রে সে আমলে মনোনয়ন দান করা হত সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে । কারণ জাতীয় স্বার্থকেই তাঁরা বড় করে দেখতেন ।

খলিফাদের বেতন ভাতা : খোলাফায়ে রাশেদীনের খলিফাদের কোনো বেতন দেয়া হত না । সরকারি অর্থে বা বাইতুল মালে তাদের কোনো প্রকার দাবি ছিল না । সাধারণ মুসলমানগণের মতো সরকারি ভাতা গ্রহণ করে তারা সরকার পরিচালনার কাজ করতেন । অবশ্য তাঁরা অনেকেই এ ভাতা মৃত্যুর আগে নিজ সম্পত্তি থেকে বাইতুল মালে ফেরত দিয়ে গেছেন । 

জীবনযাত্রা : খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে খলিফাদের জীবনযাত্রা ছিল সাধারণ ও অনাড়ম্বর । খলিফাগণ মসজিদে বসেই রাজকার্য পরিচালনা করতেন ।

 খোলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন : সাম্যবাদের মূর্ত প্রতীক হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম . ) কাউকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাননি । তার কোনো পুত্র সন্তানও তাঁর ইনতিকালের সময়ে জীবিত ছিলেন না । এ কারণে মুসলিম উম্মাহর মধ্য থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে খলিফা নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু হয় । খোলাফায়ে রাশেদীনের চারজন খলিফা কিভাবে কোন পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন তার একটি বিবরণ নিচে তুলে ধরা হল । 


হযরত আবু বকর ( রা . ) এর খলিফা নির্বাচন : হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) - এর ইন্তিকালের পর আনসারগণ সহীফায়ে বনি সায়েদা নামক মিলনায়তনে একত্রিত হন এবং খিলাফত সম্পর্কে আলোচনা করেন । আনসারগণ চেয়েছিলেন- খলিফা দু'জন হোক । একজন আনসারদের মধ্য থেকে অন্যজন মুহাজিরদের মধ্য থেকে । এ কথা সুস্পষ্ট যে , খলিফা দু'জন হলে তা সাংঘাতিক মতানৈক্যের কারণ হতো । শুধু আনসারদের মধ্যে থেকেও খলিফা নির্বাচন করা সম্ভব ছিল না । খিলাফতকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয় ।

 মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর চাচাত ভাই ও জামাতা হিসেবে একদল মুহাজির হযরত আলী ( রা . ) কে রসুলের উত্তরাধিকারী বলে প্রচারণা চালান । এদিকে আনসারগণ কাযরায় গোত্রের দলপতি হযরত সা'দ বিন আবু উবায়দাকে খলিফা নির্বাচনের দাবী জানান । এই বিষয়ে যখন বাক - বিতন্ডা শুরু হলো তখন হযরত আবু বকর ( রা ) খুবই উত্তম পন্থায় আনসারদের বুঝাতে সক্ষম হলেন হযরত উমর ( রা ) এর উদ্দীপনায় সবাই এ ব্যাপারে একমত হলেন যে , হযরত আবু বকর সিদ্দিক ( রা . ) - এর উপর খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করা হোক । 

অতঃপর মুহাজিরদের মধ্য হতে সর্বপ্রথম হযরত উমর ( রা . ) এবং আনসারদের মধ্য হতে হযরত বাসির ইবনে সা'দ ( রা ) হযরত আবু বকর ( রা . ) এর হস্ত ধারণ করে বাইআত গ্রহণ করলেন । তারপর উপস্থিত জনতা বাইআত গ্রহণ করেন । মোট কথা এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ভালোভাবে সমাধা হয়ে গেল এবং মুসলমানগণ হযরত নবি করিম ( স . ) এর কাফন - দাফনে মনোনিবেশ করেন । বয়োজেষ্ঠ্যতা , রাজনৈতিক দুরদর্শিতা সূক্ষ্ম বিচার - বুদ্ধি , নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ , সামাজিক কার্যকলাপ ও ব্যক্তিগত প্রভাবের জন্য ইসলামি রীতিতে হযরত আবু বকর ( রা . ) খলিফা নির্বাচিত হন । তাকে খলিফা নির্বাচনে রসুল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) - এর সুস্পষ্ট নির্দেশ না থাকলেও পরোক্ষ ইঙ্গিত ছিল । খলিফা নির্বাচিত হয়ে হযরত আবু বকর ( রা ) ইসলামের সাম্যবাদ ও ভ্রাতৃত্ববোধে মুসলিম জাহানকে উদ্বুদ্ধ করেন ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ