কেন ইতিহাস বদলে দেয় বদর যুদ্ধ | বদরের যুদ্ধের ইতিহাস ও কারণ

 যুদ্ধ ও শান্তি নীতি বদরের যুদ্ধ  মার্চ , ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ  হিজরতের পর মদিনায় ইসলামের দৃঢ় প্রতিষ্ঠা ও প্রসার , হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) - এর প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি ও কর্মকাণ্ডের সাফল্য লাভ এবং মদিনা নগরীর শাসন শৃঙ্খলা উন্নতি হওয়ার মক্কার কুরাইশদের মনে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের সঞ্চার হয় । এই ঈর্ষা ও শত্রুতা থেকেই পৌত্তলিক মক্কাবাসী মহানবির ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর সঙ্গে প্রথম যে সংঘর্ষের সুত্রপাত ঘটায় ইসলামের ইতিহাসে তা “ গাজওয়ারে বদর ”  বা বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত ।

 বদরের যুদ্ধের কারণ : মক্কার কুরাইশদের শত্রুতা  মদিনায় ধর্মভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামকে আন্তর্জাতিককরণে মহানবির প্রচেষ্টার মক্কার কুরাইশগণ ঈর্ষান্বিত হয় । তারা জন্মভূমি মক্কা হতে হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) কে বিতাড়িত করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তাকে সব প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে ।

আবদুল্লাহে ইবনে উবাই - এর ষড়যন্ত্র : হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) -এর অসামান্য প্রাধান্য খর্ব করার জন্য বানু খাজরাজ বংশীয় আবদুল্লাহ বিন উবাই নামক একজন প্রতিপত্তিশালী মুনাফিক নেতা গোপনে ষড়যন্ত্র করতে থাকে । কেননা হিজরতের পূর্বে মদিনায় তার শাসকরূপে অধিষ্ঠিত হবার কথা ছিল ; কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও মদিনা সনদের পরিপ্রেক্ষিতে তার আশা পূর্ণ হয়নি । এর ফলে যে মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে দুরভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপে নিয়োজিত হয় এবং মদিনায় হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) - এর বিরুদ্ধে প্রচারণা ও বিরুদ্ধাচরণ দ্বারা একটি মুনাফিক দল গঠন করে । ইসলামের প্রতি বাহ্যিক আনুগত্য স্বীকার করলেও আবদুল্লাহর নেতৃত্বে মুনাফিক দল হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) এর বিরুদ্ধে শত্রুতা করেন । 

মদিনার ইহুদিদের ষড়যন্ত্র : মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় প্রথমে হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) কে সানন্দে বরণ করলেও তার ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তি ও সুনাম তাদেরকে অত্যন্ত বিক্ষুদ্ধ করে তোলে । মদিনা সনদে তাদেরকে সকল প্রকার ধর্মীয় ও নাগরিক স্বাধীনতা প্রদান সত্ত্বেও ইহুদিগণ কোনদিনই মুসলমানদের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব প্রকাশ করেনি ।

 উপরন্তু মদিনা সনদের শর্ত লংঘন করে তারা কুরাইশদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র ও গুপ্ত সংবাদ প্রেরণ করে ইসলাম ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিলোপ সাধন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে । এমনকি তারা মদিনা আক্রমণের জন্য শত্রুদেরকে প্ররোচিত করতে থাকে । সৈয়দ আমীর আলী যথার্থই মন্তব্য করেন , সমগ্র মদিনা বিদ্রাহ ও বিশ্বাসঘাতকতায় ভরে গিয়েছিল ।

আর্থিক কারণ : মক্কা হতে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য পথে মদিনা অবস্থিত ছিল । এই জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মদিনার গুরুত্ব অপরিসীম । বাণিজ্য পথ ব্যতীত এই পথটি হজ্জ যাত্রীদের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল । মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) কর্তৃক মদিনায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে কুরাইশগণ নির্বিঘ্নে ব্যবসায় বাণিজ্য করার সুযোগ হারাতে পারে এ আশঙ্কায় মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রের পতন ঘটানোর জন্য তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে ।

কুরাইশদের হিংসাত্মক কার্যকলাপ : পবিত্র কা'বা গৃহের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকায় সমগ্র আরবের পৌত্তলিকদের মধ্যে কুরাইশদের অপরিসীম প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । মক্কা ও মদিনার বাণিজ্যে পথে বসবাসকারী বিভিন্ন আরব গোত্র কুরাইশদের সাথে গোপনে যোগসূত্র স্থাপন করে হযরতের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকলে মুসলমানদের নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয় । মদিনার সীমান্তবর্তী এলাকায় কুরাইশগণ অথবা তাদের সাহায্যকারী আরব গোত্র মুসলমানদের শস্যক্ষেত্র জ্বালিয়ে দিত , ফলবান বৃক্ষ ধ্বংস করত এবং উট ও ছাগল অপহরণ করত । এই প্ররোচনামূলক ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন । 

নাখলার খন্ডযুদ্ধ : কুরাইশদের ক্রমবর্ধমান আক্রমণ ও লুটতরাজ বন্ধ করার জন্য মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) হযরত আবদুল্লাহ ইবন জাহাশের নেতৃত্বে ১২ জনের একটি গোয়েন্দা দল সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রেরণ করেন । হযরতের নির্দেশ অনুযায়ী তিনদিন পর সীলমোহরকৃত আদেশপত্র উন্মোচন করে হযরত আবদুল্লাহ সঙ্গীদের নিয়ে নাখলার দিকে অগ্রসর হওয়ার এবং মক্কা কাফেলার জন্য অপেক্ষা করার নির্দেশ পেলেন ।

 লক্ষণীয় যে মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) কাফেলা আক্রমণ করতে আদেশ করেন নি । কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ ( রা . ) ভুলক্রমে চারজন যাত্রীর মক্কার এক কাফেলা আক্রমন করলে নাখলায় একটি খন্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয় । এর ফলে কুরাইশ নেতা আমর বিন হাযরামী নিহত ও অপর দুইজন বন্দী হয় । নাখলার খণ্ড যুদ্ধকে বদরের যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে গণ্য করা হয় । কিন্তু এটি ছিল একটি অজুহাত মাত্র । কেননা তারা অনেকদিন আগ থেকেই ইসলামের উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধিতে চিন্তিত হয়ে এর ধ্বংস সাধনে প্রবৃত্ত হয় ।

আবু সুফিয়ানের কাফেলা আক্রমণের মিথ্যা গুজব : ইসলামের ঘোরতর শত্রু আবু সুফিয়ান অস্ত্র সংগ্রহের জন্য বাণিজ্যের অজুহাতে এক কাফেলা নিয়ে সিরিয়া গিয়েছিল । নাখলা যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে কুরাইশগণ মক্কায় কাফেলার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে । এসময় এক ভিত্তিহীন জনরব উঠল যে , আবু সুফিয়ানের কাফেলা মদিনার মুসলমান অধিবাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে । এ গুজবের সত্যতা যাচাই না করেই আক্রমনাত্মক নীতি অনুসরণ করে আবু জাহল ১০০০ সৈন্য নিয়ে আবু সুফিয়ানের সাহায্যার্থে মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হয় ।



বদর যুদ্ধের ঘটনা : এমতাবস্থায় মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) ঐশীবাণী লাভ করে অনুপ্রাণিত হলেন । ওহি নাযিল হয় “ আল্লাহর পথে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ” । সাথে সাথে মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) নেতৃস্থানীয় সাহাবাদের পরামর্শে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । এরই ধারাবাহিকতায় আনসার এবং মুহাজির গিয়ে গঠিত মাত্র ৩১৩ জনের একটি মুসলিম বাহিনী কুরাইশ বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য বদর অভিমুখে রওনা হয় । 

মদিনা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে বদর উপত্যকায় ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে ১৩ মার্চ ( ১৭ ই রমযান , শুক্রবার দ্বিতীয় হিজরি ) মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে কুরাইশদের সংঘর্ষ হয় । হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করেন । আল - ওয়াকিদী বলেন হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) মুসলিম সৈন্য সমাবেশের জন্য এমন একটি স্থান বেছে নেন যেখানে সূর্যোদয়ের পরে যুদ্ধ শুরু হলে কোন মুসলমান সৈন্যের চোখে সূর্য কিরণ পড়বে না । 

প্রথম প্রাচীন আরব রেওয়াজ অনুসারে মল্লযুদ্ধ হয় । মহানবির নিদেশে হযরত আমির হামজা ( রা ) হযরত আলী ( রা ) ও হযরত আবু ওবায়দা ( রা . ) কুরাইশ পক্ষের নেতা উতবা , শায়বা এবং ওয়ালিদ বিন উতবার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ অবতীর্ণ হন । এতে শত্রুপক্ষীয় নেতৃবৃন্দ শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হয় । উপায়ন্তর না দেখে আবু জাহলের নেতৃত্বে কুরাইশগণ মুসলমানদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে । তারা মুসলমানদের উপর প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ চালাতে লাগল , কিন্তু প্রতিকূল অবস্থায় সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল মুসলিম বাহিনীর মোকাবিলা করা কুরাইশদের পক্ষে সম্ভব হয়নি ।

 অসামান্য রণ নৈপূণ্য , অপূর্ব বিক্রম ও অপরিসীম নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে যুদ্ধ করে মুসলমানগণ কুরাইশগণকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন । বদর যুদ্ধে মহান আল্লাহ হাজার হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করেন । এ যুদ্ধে ৭০ জন কুরাইশ সৈন্য নিহত হয় ও সমসংখ্যক সৈন্য বন্দি হয় ।

 অপরদিকে মাত্র ১৪ জন মুসলিম সৈন্য শাহাদাত বরণ করেন । আবু জাহল এ যুদ্ধে নিহত হয় । হযরত মুহাম্মদ ( স . ) যুদ্ধবন্দীদের প্রতি যে উদার ও মধুর ব্যবহার করেন তা তাঁর মহানুভবতার পরিচয় বহন করে । মুক্তিপণ গ্রহণ করে কুরাইশ বন্দীদেরকে মুক্তি প্রদান করা হয় । মাত্র ৪০০০ দিরহাম মুক্তিপণ নির্ধারিত হয় । যারা মুক্তিপণ দিতে অক্ষম তারা মুসলমানদের বিরোধিতা না করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে ও মুসলমান বালককে শিক্ষাদান করার অঙ্গীকার করে মুক্তি লাভ করে ।

বদর যুদ্ধের গুরুত্ব : সামরিক প্রজ্ঞার পরিচয় বিশাল কুরাইশ বাহিনী স্বল্পসংখ্যক মুসলিম সৈন্যের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে বিধর্মীগণ ইসলাম ধর্ম ও মদিনা রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠে । সৈন্যসংখ্যা যুদ্ধে ভাগ্য নির্ধারণ করে এ ধারণা ভ্রান্তিতে পরিণত হয় এবং মুসলমানদের মনে অসামান্য সাহস , উদ্দীপনা ও আত্মপ্রত্যয়ের সঞ্চার করে যা মুসলমানদের ভবিষ্যতের যুদ্ধ জয়ের এক দূর্বার আকাঙ্খায় উদ্বুদ্ধ করে ।

 ইসলাম প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি  বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সম্প্রসারণের সূচনা করে এবং পরবর্তী একশ বছরের মধ্যে ( ৬২৪-৭২৪ ) ইসলাম পশ্চিমে আফ্রিকা হতে পূর্বে ভারতবর্ষ ও মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে । যোসেফ হেল বলেন— পরবর্তীকালে সমস্ত সামরিক বিজয় এ যুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রদর্শিত ও বিকশিত আরব গুণাবলির জন্যই সম্ভব হয় । যথা- শৃঙ্খলা ও মৃত্যুর প্রতি অবহেলা । হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে নির্দেশ দেন , তোমরা কেউ সারি ভেঙে এগিয়ে যেওনা এবং আমার আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু করো না ।

চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণকারী যুদ্ধ : মক্কার প্রায় এক সহস্র বীর সেনার বিরুদ্ধে তিনশত তের জন মুসলমানের যুদ্ধভিযান যে অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জ্ঞানের , অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংঘর্ষ তা নিশ্চিতরূপে বলা যেতে পারে । এ যুদ্ধে জয়লাভ না করলে ইসলাম শুধু রাষ্ট্র হিসেবেই নহে ধর্ম হিসেবেও ধরণীর বুক হতে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত । 

  বদরের যুদ্ধ মুষ্টিমেয় মুসলমানদের মনে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জেহাদের অনুপ্রেরণা প্রদান করে । তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে আল্লাহ স্বয়ং তাদের সাহায্যকারী । ধর্মযুদ্ধে জীবিত অবস্থায় গাজী ও মৃত্যুতে শহীদ হওয়ার প্রেরণা এবং পারলৌকিক পুরস্কার লাভের বাসনা তাদের পরবর্তী বিজয়গুলোতে প্রভাব বিস্তার করে । 

রাজনৈতিক নেতা হিসেবে মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) - এর স্বীকৃতি : বদরের যুদ্ধ বিজয় ইসলাম প্রচারে নব দিগন্তের সূচনা করে । ইসলামের মর্যাদা ও দক্ষতা বৃদ্ধির কথা এবং গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলের কথা চিন্তা করে নিকলসন বলেন , বদরের যুদ্ধ ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় যুদ্ধের অন্যতম । বদরের প্রান্তরে বিজয় লাভের ফলে সকলের দৃষ্টি মুহাম্মদ ( স . ) এর উপর নিবদ্ধ হল । আরবগণ তাঁর ধর্মকে যতই উপেক্ষা করুক না কেন , তাঁকে সম্মান না করে পারল না । এ যুদ্ধ ইসলামকে মদিনা প্রজাতন্ত্রের ধর্ম হতে একটি সুসংঘবদ্ধ রাষ্ট্রের ধর্মে উন্নীত করে ।

ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মনে ভীতি : ইহুদি ও খ্রিস্টান আরবগণ ইসলামের অসীম ক্ষমতার বিরুদ্ধাচরণ হতে সাময়িকভাবে বিরত থাকল । মুনাফিকগণ ধর্মদ্রোহিতার জঘন্য পাপাচার হতে ক্ষনিকের জন্য নিবৃত্ত রইল । বিধর্মীরা হযরতের ঐশ্বরীক ক্ষমতায় আকৃষ্ট হল এবং মুসলমানগণ বদরের বিজয়কে আল্লাহর প্রতিশ্রুত পুরস্কারস্বরূপ গ্রহণ করে তৌহিদ ও নবুয়তে অটল রইল । 

বিশ্ব বিজয়ের সূচনা : বদরের যুদ্ধের মহাবিজয় ইসলামকে কেবল আরবেই নয় , অনারব অঞ্চলও সর্বজনীন করে তোলে । এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার জনৈক লেখক বলেন , বদরের যুদ্ধ শুধু একটি বিখ্যাত যুদ্ধই নয় এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম । ইহা হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতেও যথেষ্ট সহায়তা করেছে ।

রাষ্ট্র নায়কের মর্যাদা লাভ :  যুদ্ধক্ষেত্র হতে বিজয়ীর বেশে মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) মদিনায় ফিরে এসে পরাক্রমশালী যোদ্ধা , সুদক্ষ সমরনায়ক ও সুবিবেচক শাসকের পূর্ণ মর্যাদা লাভ করেন । ঘটনাবলি বিচারে হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) একজন যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতা তা প্রমানিত হল । এ বিজয়ের ফলে হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) একাধারে নবি ও রাষ্ট্র পরিচালকের দায়িত্বভার পরিচালনা করতে থাকেন ।

 মুসলমানদের বদর বিজয় ইসলামের অপরাজেয় শক্তির পরিচায়ক । এর ফলে ইহুদি এবং খ্রিষ্টানগণ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়ে । প্রকাশ্যে ধর্মপ্রচার ও আচার অনুষ্ঠান পালন , রাষ্ট্রীয় কার্য তত্ত্বাবধান , যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালনা , দূত প্রেরণ দ্বারা বহির্বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও পরিধী বৃদ্ধি পায় এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে । তবে তাদের বিরুদ্ধাচরন বন্ধ হয়নি । 

বদর যুদ্ধের গুরুত্ব সম্পর্কে অধ্যাপক পি.কে হিট্রি বলেন ইতোপূর্বে রাষ্ট্রীয় ভিত্তি ব্যতিরেকে ইসলাম শুধু ধর্ম মাত্র ছিল । এখন থেকেই ইসলাম একটি রাষ্ট্রের ধর্মে পরিণত হল । বদরের পরে মদিনাতে এটা রাষ্ট্রীয় ধর্মের থেকেও বড় ভূমিকা পালন করেছিল ।

 অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম নিজেই একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল । সে সময় এবং সেখান থেকেই ইসলাম পরিনত হয় একটি সংগঠিত রাষ্ট্রে এবং সারা বিশ্ব তাকে সেভাবেই স্বীকৃতি দিয়েছে । বস্তুতপক্ষে বদরের যুদ্ধ বহুঈশ্বরবাদী , পৌত্তলিক ও একেশ্বরবাদী ইসলাম এবং জাহেলিয়ার বর্বরতা ও ইসলামি রেনেসার মধ্যে সংগ্রাম । এজন্য বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে একটি যুগসন্ধিক্ষণকারী ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ