স্থিতি ও গতি কী ? কেন প্রয়োজন || What is the position and speed

 


স্থিতি এবং গতি ( Rest and Motion ) আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তার মাঝে কোনটি স্থির বা স্থিতিশীল এবং কোনটি চলমান বা গতিশীল সেটি বুঝতে আমাদের কখনো অসুবিধা হয় না । আমাদের চোখ দিয়ে আমরা এমনভাবে দেখি যে , কোনো কিছু একটুখানি নড়লেই আমরা চট করে সেটা ধরে ফেলতে পারি । কাজেই স্থিতি বা গতি বলতে কী বোঝায় সেটি আমরা খুব চমৎকারভাবে অনুভব করতে পারি ।

 কিন্তু র্বিজ্ঞানের জন্য শুধু অনুভব করা যথেষ্ট নয় , সেটাকে ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হয় । সেটি করার জন্য আমরা এক কথায় বলতে পারি যে সময়ের সাথে কোনো কিছুর অবস্থানের যদি পরিবর্তন না হয় তাহলে সেটি স্থির , আর যদি অবস্থানের পরিবর্তন হয় তাহলে সেটি গতিশীল । 

এখন আমাদের অবস্থান ' শব্দটির ভালো করে ব্যাখ্যা করা দরকার । আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় আমরা নানাভাবে অবস্থান শব্দটি ব্যবহার করলেও বিজ্ঞানের ভাষায় অবস্থান শব্দটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে । যেমন তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তোমার স্কুলের অবস্থান কোথায় এবং তুমি যদি উত্তর দাও ' ঝিলটুলি'তে তাহলে উত্তরটি সঠিক হলেও স্কুলের অবস্থানটি কিন্তু জানা গেল না । 

তুমি যদি উত্তর দাও , তোমার স্কুলটি তোমার বাসার গেট থেকে এক কিলোমিটার দূরে , তাহলেও কিন্তু স্কুলের অবস্থান জানা গেল না । তোমার বাসার গেটটি কোথায় সেটি আমাদের জানা থাকলেও আমরা বলতে পারব না স্কুলটি সেখান থেকে ঠিক কোন দিকে এক কিলোমিটার দূরে ।

 কিন্তু তুমি যদি বলো স্কুলটি তোমার বাসার গেট থেকে পূর্ব দিকে এক কিলোমিটার দূরে তাহলেই শুধু আমরা সুনির্দিষ্টভাবে তোমার স্কুলের অবস্থানটি জানতে পারব । অর্থাৎ স্কুলের অবস্থান জানার জন্য দূরত্ব এবং দিক দুটিই সুনির্দিষ্টভাবে জানতে হয় । 

শুধু তাই নয় , সেই দূরত্ব এবং দিকটি নির্দেশ করতে হয় একটি নির্দিষ্ট বিন্দু বা প্রসঙ্গ বিন্দুর অবস্থান থেকে । তোমার স্কুলের বেলায় প্রসঙ্গ বিন্দু ( origin ) ছিল তোমার বাসার গেট । সেটি তোমার বাসার গেট না হয়ে একটা বাস স্টপ কিংবা একটা শপিং মল হতে পারত । তাহলে অবশ্যই দূরত্ব এবং দিকটির ভিন্ন মান হতো কিন্তু অবস্থানটি অবশ্যই এই নতুন প্রসঙ্গ বিন্দুর সাপেক্ষে বলে দিতে পারতাম । 

অর্থাৎ কোনো কিছুর অবস্থান বলতে হলে সেটি বলতে হয় কোনো একটি প্রসঙ্গ বিন্দুর সাপেক্ষে । এই প্রসঙ্গ বিন্দুটি চূড়ান্ত কোনো বিষয় নয় , আমরা আমাদের সুবিধা অনুযায়ী যেকোনো বিন্দুকে প্রসঙ্গ বিন্দু বা মূল বিন্দু হিসেবে ধরতে পারি । এখন প্রশ্ন হচ্ছে অবস্থান নির্দিষ্ট করার জন্য আমাদের যে প্রসঙ্গ বিন্দু বা মূল বিন্দু ধরে নিতে হয় সেই বিন্দুটি কি স্থির একটি বিন্দু হওয়া প্রয়োজন ? 

ধরা যাক তোমার সামনে আরেকজন চেয়ারে স্থির হয়ে বসে আছে । তোমার চেয়ারটাকে যদি প্রসঙ্গ বা মূল বিন্দু ধরে নিই তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে তোমার বন্ধুর অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না । 

 কিন্তু যদি এমন হয় তোমরা আসলে চলন্ত একটি ট্রেনে বসে আছ তাহলে কী হবে ? ট্রেনের বাইরে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ বলবে , তুমি কিংবা তোমার বন্ধু দুজনেই গতিশীল , কেউ স্থির নয় । তাহলে কার কথাটি সত্যি ? 

তোমার , নাকি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির ? আসলে তোমার কিংবা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির , দুজনের কথাই সত্যি ! তার কারণ মূল বিন্দু বা প্রসঙ্গ বিন্দু যদি সমবেগে চলতে থাকে তাহলে আমরা কখনোই জোর দিয়ে বলতে পারব না যে প্রসঙ্গ বিন্দুটি কি । সমবেগে চলছে নাকি এটা আসলে স্থির এবং অন্য সবকিছু উল্টো দিকে সমবেগে চলছে ! কাজেই আমরা বলতে পারি যদি কোনো একটি মূল বিন্দুর সাপেক্ষে কোনো বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন হয় 

তাহলে সেই বস্তুটি ঐ বিন্দুর সাপেক্ষে গতিশীল । মূল বিন্দুটি কি আসলে স্থির নাকি সমবেগে চলছে সেটি নিয়ে আমরা মাথা ঘামাব না । সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয় , তার কারণ সব গতিই আপেক্ষিক । শুধু তাই নয় , আমরা যদি সত্যিকারের স্থির কোনো একটি প্রসঙ্গ বিন্দু খুঁজে বেড়াই তাহলে বিপদে পড়ে যাব । পৃথিবীর পৃষ্ঠে কোনো কিছুকে মূল বিন্দু ধরে নিলে একজন আপত্তি করে বলতে পারে পৃথিবী তো স্থির নয় সেটা নিজের অক্ষের উপর ঘুরছে কাজেই পৃথিবী পৃষ্ঠের সবকিছু ঘুরছে । 

আমরা বুদ্ধি করে বলতে পারি পৃথিবীর কেন্দ্র হচ্ছে মূল বিন্দু । তখন আরেকজন আপত্তি করে বলতে পারে যে সেটিও স্থির নয় , সেটি সূর্যের চারদিকে ঘুরছে । আমরা তখন আরো বুদ্ধি খরচ করে বলতে পারি সূর্যের কেন্দ্রবিন্দুটিই হোক মূল বিন্দু ! তখন অন্য কেউ আপত্তি করে বলতেই পারে সূর্যও তো স্থির নয় , সেটাও তো আমাদের গ্যালাক্সির ( বাংলায় নামটি ছায়াপথ , ইংরেজিতে Milky Way ) কেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরছে ।

 বুঝতেই পারছ তখন কেউ আর সাহস করে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে মূল বিন্দু বলবে না ! গ্যালাক্সি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড স্থির কে বলেছে ? শুধু তাই নয় , গ্যালাক্সির কেন্দ্রবিন্দুকে মূল বিন্দু ধরা হলে পৃথিবী পৃষ্ঠের একটা অবস্থান বর্ণনা করতে আমরা কী পরিমাণ জটিলতায় পড়ে যাব কেউ চিন্তা করেছ ? 

আসলে এত জটিলতার কোনো প্রয়োজন নেই , আমাদের কাজ চালানোর জন্য আমাদের কাছে স্থির মনে হয় এরকম যেকোনো বিন্দুকে মূল বিন্দু ধরে সব কাজ করে ফেলতে পারব , শুধু বলে নিতে হবে সব মাপজোখ এই মূল বিন্দুর সাপেক্ষে করা হয়েছে । বিজ্ঞানীরা এভাবে পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াস থেকে শুরু করে মহাকাশে পাঠানো উপগ্রহ সবকিছুর মাপজোখ করে ফেলতে পারেন , কখনো কোনো সমস্যা হয়নি ! 

 


** বিভিন্ন ধরণের গতি **

 আমরা আমাদের চারপাশে অনেক রকম গতি দেখতে পাই , কোনো কিছু নড়ছে , কোনো কিছু কাঁপছে , কোনো কিছু ঘুরছে , কোনো কিছু সরে যাচ্ছে — এই সবই হচ্ছে নানা রকম গতির উদাহরণ । সম্ভাব্য , গতির কোনো শেষ নেই কিন্তু আমরা ইচ্ছে করলে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ গতির কথা আলাদা করে বলতে পারি ।

 সরলরৈখিক গতি ( Linear Motion ) এটি সবচেয়ে সহজ গতির উদাহরণ । কোনো কিছু যদি সরলরেখায় যায় তাহলে তার গতিটি হচ্ছে সরলরৈখিক গতি ) কোনো কিছুকে সমতলপৃষ্ঠে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিলে সেটা সরলরেখায় যেতে থাকে । একটা বলকে উপর থেকে ছেড়ে দিলে সেটা সোজা নিচের দিকে পড়ে , কাজেই সেটাও রৈখিক গতি ।

 ঘূর্ণন গতি ( Circular Motion ) ( কোনো কিছু যদি একটা নির্দিষ্ট বিন্দুর সমদূরত্বে থেকে ঘুরতে থাকে তাহলে সেটাকে বলে ঘূর্ণন গতি ) বৈদ্যুতিক পাখা , ঘড়ির কাঁটা এগুলো ঘূর্ণন গতির উদাহরণ হলেও চমকপ্রদ একটা উদাহরণ হচ্ছে আকাশের চাঁদ । চাঁদকে কোনো কিছু দিয়ে পৃথিবীর সাথে বেঁধে রাখা নেই তবু এটা পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে , শুধু তাই নয় , এটা টুপ করে পৃথিবীতে পড়েও যাচ্ছে না !

 চলন গতি ( Translational Motion ) কোনো কিছু যদি এমনভাবে চলতে থাকে যেন বস্তুর সকল কণা একই সময় একই দিকে যেতে থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে চলন গতি ) আমরা আমাদের চারপাশে মাঝে মাঝে এরকম অনেক উদাহরণ দেখতে পাই । কোনো কিছু যখন সোজা ( রৈখিক গতি ) যায় তখন তার উদাহরণ দেখা খুব সহজ । গাড়ির ঘূর্ণায়মান ঢাকা বিবেচনায় না আনলে সোজা এগিয়ে যাওয়া একটা গাড়ি চলন গতির উদাহরণ , তখন গাড়ির প্রতিটি বিন্দু একই সময় একই দিকে একই দূরত্ব অতিক্রম করছে । চলন গতির উদাহরণ চলন গতি সোজা হতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই কিন্তু আঁকাবাঁকা পথে চলন গতি উদাহরণ সহজে পাওয়া যাবে না । 

 পর্যায়বৃত্ত গতি ( Periodic Motion ) ( কোনো গতিশীল বস্তু যদি নির্দিষ্ট সময় পর পর একটি নির্দিষ্ট বিন্দু দিয়ে একই দিকে একইভাবে অতিক্রম করে তাহলে সেটাকে পর্যায়বৃত্ত গতি বলা যায় ) আমাদের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন পর্যায়বৃত্ত কারণ সেটি নির্দিষ্ট সময় পর পর একইভাবে একই দিকে স্পন্দিত বা গতিশীল হয় । পর্যায়বৃত্ত গতি বৃত্তাকার ( ফ্যানের পাখা ) , উপবৃত্তাকার ( সূর্যকে ঘিরে হ্যালির ধূমকেতুর কক্ষপথ ) , কিংবা সরলরৈখিক ( স্প্রিংয়ে ঝুলিয়ে রাখা দুলতে থাকা বস্তু ) হতে পারে । ঘূর্ণন গতি একটি বিশেষ ধরনের পর্যায়বৃত্ত গতি । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ