আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কিসের তৈরী? মাটির নাকি নূরের? এর সঠিক ব্যাখ্যা কী?/What is our beloved Prophet Muhammad (peace be upon him) made of? Earth or light? What is the correct explanation


রাসূল (ﷺ) কে "আল্লাহর নূর বা আল্লাহর যাতি নূর বা যাতি নূরের তাজাল্লী বা আল্লাহর যাতি নূরের জ্যোতি" বলা যাবে কি না?

অনেকে বলেন কোরআনে নূর বলা হয়েছে কিন্তু নূরের তৈরী বলা হয়নি, আবার কেউ বলেন শুধু রুহ মোবারক নূর কিন্তু দেহমোবারক নয়,আবার কেউ বলেন সাদা মাটির তৈরী (নাউযুবিল্লাহ!) আজকে ইন-শা-আল্লাহ সে বিষয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো-


আজকের আলোচনা

রাসূল (ﷺ) হলেন সর্বপ্রথম সৃষ্টি,যাঁকে সৃষ্টি না করলে কোন কিছুই সৃষ্টি হতো না।


★ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নূর হিসাবে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয়েছেন সে প্রসঙ্গে একটু অন্যভাবে বিশ্লেষন করা যাক: 


লক্ষ্য করুন! অন্যান্য নবী রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের বেলায় আল্লাহ পাক خلق শব্দটা সরাসরি ব্যবহার করেছেন।আরবী خلق শব্দের অর্থ হচ্ছে- শূন্যকে অস্তিত্ব দান করা,যে কিছু নয় তাকে কিছু করে দেয়া,সৃষ্টি করা ইত্যাদি।কিন্তু হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিশেষ শান মুবারক উনার জন্য কালামুল্লাহ শরীফে خلق শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি।যেমন:


  প্রথম,(بعث)=প্রেরণ করেছেন

*১. আল্লাহ পাক বলেন 


 لقد من الله علي المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا

অর্থ: আল্লাহ পাক মু’মিনদের প্রতি ইহসান করে তাদের মধ্যে হতে একজন রাসূল প্রেরন করেছেন।”

[সূরা আল ইমরান,আয়াত নং ১৬৪]


*২. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-


ﻫﻮ ﺍﻟﺬﻱ ﺑﻌﺚ ﻓﻲ ﺍﻷﻣﻴﻴﻦ ﺭﺳﻮﻻً ﻣﻨﻬﻢ ﻳﺘﻠﻮ ﻋﻠﻴﻬﻢ ﺀﺍﻳﺎﺗﻪ ﻭﻳﺰﻛﻴﻬﻢ ﻭﻳﻌﻠﻤﻬﻢ ﺍﻟﻜﺘﺎﺏ ﻭﺍﻟﺤﻜﻤﺔ ﻭﺇﻥ ﻛﺎﻧﻮﺍ ﻣﻦ ﻗﺒﻞ ﻟﻔﻲ ﺿﻼﻝ ﻣﺒﻴﻦ } [ ﺍﻟﺠﻤﻌﺔ 2 : ] .


তিঁনি নিরক্ষরদের মাঝে একজন রাসূল পাঠালেন।যিঁনি তার আয়াত সমূহ থেকে পাঠ করবেন,এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবেন। যদিও তোমরা ইতিপূর্বে স্পস্ট গোমরাহীতে ছিলে।

[সুরা জুমুআ,আয়াত নং ২]


*৩. রাসূল (ﷺ)-ইরশাদ করেন-


ﺇﻧﻤﺎ . ﺑﻌﺜﺖ ﻣﻌﻠﻤﺎ ﺭﻭﺍﻩ ﺍﺑﻦ ﻣﺎﺟﺔ 229


নিশ্চয়ই আঁমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।

[ইবনে মাজাহ,২২৯]


দ্বিতীয়,(ارسلنا)=প্রেরণ করেছি

*১.আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন


كَمَآ أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِّنكُمْ يَتْلُوا۟ عَلَيْكُمْ ءَايَٰتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُوا۟ تَعْلَمُونَ


অর্থঃ যেমন,আঁমি পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে একজন রসূল, যিঁনি তোমাদের নিকট আঁমার বাণীসমুহ পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন; আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও তাঁর তত্ত্বজ্ঞান এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয় যা কখনো তোমরা জানতে না।

[সূরা আল বাকারা,আয়াত নং ১৫১]


*২. আল্লাহ পাক আরও বলেন


 ياايها النبي انا ارسلناك شاهدا و مبشر ونذيرا

অর্থ : হে আঁমার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! নিশ্চয়ই আঁমি আঁপনাকে সক্ষীদাতা, সুসংবাদদাতা, এবং ভয় প্রদর্শনকারী রুপে প্রেরন করেছি।”

[সূরা আহযাব,আয়াত নং ৪৫]


*৩. পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে:

 وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ


অর্থঃহে রাসূল! "আঁমি আঁপনাকে সমগ্র কুল মাখলুকাতের জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি"

[সূরা আম্বিয়া,আয়াত নং ১০৭]


*৪. আরও ইরশাদ হয়েছে:


هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُشْرِكُونَ


অর্থঃ তিঁনিই প্রেরণ করেছেন আঁপন রসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে, যেন এ দ্বীনকে অপরাপর দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপ্রীতিকর মনে করে।

[সূরা আত-তাওবাহ্‌,আয়াত নং ৩৩]


*৫. পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে:

إِنَّآ أَرْسَلْنَٰكَ شَٰهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا


অর্থঃ আঁমি আঁপনাকে প্রেরণ করেছি অবস্থা ব্যক্তকারীরূপে, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারীরূপে।

[সূরা আল ফাত্‌হ,আয়াত নং ৮]


*৬. পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে:


هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ شَهِيدًا

অর্থঃ তিঁনিই তাঁর রসূলকে হেদায়েত ও সত্য ধর্মসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে একে অন্য সমস্ত ধর্মের উপর জয়যুক্ত করেন। সত্য প্রতিষ্ঠাতারূপে আল্লাহ যথেষ্ট।

[সূরা আল ফাত্‌হ,আয়াত নং ২৮]


*৭. আরও ইরশাদ হয়েছে:


وَمَآ أَرْسَلْنَٰكَ إِلَّا كَآفَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ


অর্থঃ আঁমি আঁপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে সুসংবাদাতা ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।

[সূরা সাবা,আয়াত নং ২৮]


*৮. পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে:


إِنَّآ أَرْسَلْنَٰكَ بِٱلْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَإِن مِّنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ


অর্থঃ আঁমি আঁপনাকে সত্যধর্মসহ পাঠিয়েছি সংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। এমন কোন সম্প্রদায় নেই যাতে সতর্ককারী আসেনি।

[সূরা ফাতির,আয়াত নং ২৪]


*৯. আরও ইরশাদ হয়েছে:


إِنَّآ أَرْسَلْنَآ إِلَيْكُمْ رَسُولًا شَٰهِدًا عَلَيْكُمْ كَمَآ أَرْسَلْنَآ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ رَسُولًا


অর্থঃ আঁমি তোমাদের কাছে একজন রসূলকে তোমাদের জন্যে সাক্ষী করে প্রেরণ করেছি, যেমন প্রেরণ করেছিলাম ফেরাউনের কাছে একজন রসূল।

[সূরা আল মুজাম্মিল,আয়াত নং ১৫]


** তৃতীয়,(جاء)=আগমন করেছেন **

*১.আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন 


 قد جاءكم من الله نور


অর্থ: নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহ পাক উঁনার পক্ষ থেকে একখানা “নূর” বা হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেছেন।”

[সূরা মায়েদা,আয়াত নং ১৫]


*২. আল্লাহ পাক আরও বলেন


لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم بِٱلْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ

অর্থঃ তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল।তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ।তিঁনি তোমাদের মঙ্গলকামী,মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল,দয়াময়।

[সূরা আত-তাওবাহ্‌,আয়াত নং ১২৮]

                     

অপরদিকে লক্ষ্য করুন: অনাদি-অনন্ত মহান সত্ত্বা আল্লাহ তায়ালা একাই ছিলেন, ছিলেন গুপ্ত।ইচ্ছা করলেন নিজেকে প্রকাশ করার,সে অনুযায়ী সৃষ্টি করলেন গোটা সৃষ্টি জগত।সৃষ্টির কেন্দ্র বানিয়েছেন যাকে,যাঁকে করেছেন সকল সৃষ্টি অস্তিত্বে আসার মাধ্যম যিনি তিঁনি হলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।যেমন: আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন:


وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالأِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ


‘আঁমি জ্বীন এবং মানবকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আঁমার ইবাদাতের জন্য।’

[সূরা যারিয়াত,আয়াত নং ৫৬]


★এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা মাহমুদ আলুসী বাগদাদী একটি হাদিসে কুদসীর উদৃতি দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:


كنت كنزا مخفيا فأحببت أن أعرف فخلقت الخلق لاعرف

‘আঁমি ছিলাম সুপ্ত গুপ্ত ভান্ডার, পছন্দ করলাম পরিচিত হতে।অতএব পরিচয়ের জন্য সৃষ্টি করলাম এক সৃষ্টিকে।’


[আল্লামা আলুসী,রুহুল মা‘আনী: ২৭ পারা, ২২ পৃষ্ঠা; শায়খ ইবনু আরাবী, ফুতুহাতে মাক্কিয়া: ১৪২; আল্লামা আবু সাউদ উমাদি, আবু সাউদ: ২/১৩০]


"হাদিস শরীফে আরও ইরশাদ হয়েছে"

كنت كنزا مخفيا فاحببت ان اعرف فخلقت الخلقت لاعرف


অর্থ: আল্লাহ পাক বলেন,আঁমি গুপ্ত ছিলাম। আঁমার মুহব্বত হলো যে,আঁমি জাহির/প্রকাশিত হই।তখন আঁমি আঁমার ( রুবুবিয়্যত) জাহির করার জন্য সৃষ্টি করলাম মাখলুকাত"

         *****দলিল*****

*১. আল মাকাসিদুল হাসানা-৮৩৮

*২. কাশফুল খিফা-২০১৩

*৩. আসনাল মুত্বলিব-১১১০

*৪. তমীযুত ত্বীব-১০৪৫

*৫. আসরারুল মরফুয়া-৩৩৫

*৬. তানযিয়াতুশ শরীয়া,১/১৪৮

*৭. আদ্দুরুল মুন্তাসিরা-৩৩০

*৮. আত তাযকিরা ফি আহাদীসিল মুশতাহিরা-১৩৬

*৯. কানযুল উম্মাল।



আল্লাহ পাক হাদীসে কুদসিতে ইরশাদ করেন-

لولاك لما اظهرت الربوبية


অর্থ : হে আঁমার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! আঁপনাকে সৃষ্টির উদ্দেশ্যে না থাকলে আঁমি রুবুবিয়্যাতই প্রকাশ করতাম না।"[কানযুল উম্মাল]


বিখ্যাত তাফসির কারক, ইমামুল মুফাসসিরীন,আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন:


ان الله تعالي خلق جميع الاشياء من نور محمد صلي الله عليه و سلم ولم ينقص من نوره سيء

অর্থ: এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক সকল মাখলুকাত "নূরে মুহম্মদী" সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সৃষ্টি করেছেন।অথচ "নূরে মুহম্মদী" সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে কিঞ্চিত পরিমানও কমে নাই।" 

[তাফসীরে রুহুল বয়ান ৭ম খন্ড ১৯৭-১৯৮ পৃষ্ঠা]

 

      *** লক্ষ্য করুন ***

উক্ত আয়াত শরীফ সমূহে তিনটা ভিন্ন ভিন্ন শব্দ রয়েছে।প্রথম আয়াত শরীফে এসেছে بعث ,দ্বিতীয় আয়াত শরীফে আছে ارسلن তৃতীয় আয়াত শরীফে এসেছে جاء ,


রাসূলের শানে শব্দ মুবারকের পবিত্রতম অর্থ গুলো হচ্ছে:


 প্রথম,(بعث)=প্রেরণ করেছেন।


দ্বিতীয়, (ارسلنا)=প্রেরণ করেছি।


 তৃতীয়, (جاء)=আগমন করেছেন।


★উক্ত আয়াত গুলো বিচার বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যে আল্লাহ তায়ালা কোরআন শরীফে জ্বীন-ইনসান, চন্দ্র-সূর্জ,আসমান-জমিনও তার ভিতরে যা কিছু আছে,হায়াত-মউত,দিবা-রাত্রি এ সকল সৃস্টির ব্যাপারে *খালাকা* শব্দ ব্যবহার করেছেন।শুধু রাসুলের ব্যাপারে "আরসালনাকা"(ارسلنا) "বা'আছা" (بعث) এবং "যা'আ"(جاء) ঘোষনা করেছেন।


★লক্ষ্য করুন পাঠকবৃন্দ,প্রেরণতো তাকেই বলা হয়,যা পূর্ব হতে নিজের কাছে মওজুদ থাকে।নিজের কাছে আগে থেকে তৈরী কোন জিনিষই কেবল মাত্র প্রেরন করা যায়।অর্থাৎ যেটা অনেক আগেই সৃষ্টি করে রাখা হয়।


যেহেতু হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পূর্ব থেকেই “নূর” হিসাবে সৃষ্টি হয়েই আছেন তাই উঁনার দুনিয়ায় তাশরীফ আনার ব্যাপারে প্রেরন বা আগমন শব্দটাই যাথাযথ।এবং নতুন করে خلق বা সৃষ্টি এই শব্দ প্রয়োগ কোন প্রয়োজনীয়তা বহন করে না।যেমন: হাদীস শরীফ ইরশাদ হয়েছে:

اول ما خلق الله نور


অর্থ: সর্বপ্রথম আঁমার নূর মুবারক সৃষ্টি করা হয়েছে ।”

[মুসনাদে আব্দুর রাজ্জাক ১৮ নং হাদীস]


[বি:দ্র: উক্ত হাদিসের সনদ ও গ্রহনযোগ্যতা এবং রাসূল (ﷺ)

সর্বপ্রথম সৃষ্টি এ নিয়ে পূর্বে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে]


কিন্তু দুনিয়াতে যখন তাশরীফ আনার বিষয় আসলো তখন আল্লাহ পাক বলে দিলেন -

قد جاءكم من الله نور


অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ পাঁক উনার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট এসেছেন একখানা নূর বা হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।”

[সূরা মায়েদা,আয়াত নং ১৫]


আবার যখন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর জাহিরী ভাবে দুনিয়ায় তাশরীফ আনার আগেকার সংবাদ জানতে চাওয়া হলো,তখন রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন:


قالوا يارسول الله صلي الله عليه و سلم متي و جبت لك انبوة قال وادم الروح و الجسد

অর্থ: ইয়া রসূলআল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! আঁপনি কখন থেকে নবী? হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন আদম আলাইহিস সালাম মাটি ও পানিতে ছিলেন।”

        *****দলিল*****

*১. তিরমীযি শরীফ ,হাদীস ৩৬০৯

*২. মুসনাদে আহমদ হাদীস ২৩৬২০

*৩. মুসতাদরেকে হাকীম, হাদীস ৪২০৯

*৪. আবী শায়বা ৩৬৫৫৩

*৫. তারীখে কবীর লি ইমাম বুখারী ৭/৩৭৪


সৃষ্টি ধারার সর্ব প্রথম সৃষ্টি যিনি,যাকে আবর্তন করে অন্যান্য সকল সৃষ্টি,তিঁনি কে- এ বিষয়ে প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ এবং হাদীস যাচাই-বাছাইয়ে অত্যন্ত কঠোরনীতি অবলম্বনকারী ইমাম ইবনু জাওযী বিশিষ্ট তাবেয়ী কা‘ব আহবার থেকে একটি হাদীস নকল করেছেন। তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-


ﻋﻦ ﻛﻌﺐ ﺍﻻٔﺣﺒﺎﺭ ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﺍٔﻧﻪ ﻗﺎﻝ : ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻟﻤﺎ ﺍٔﺭﺍﺩ ﺍﻟﻠﻪ ﺳﺒﺤﺎﻧﻪ ﻭﺗﻌﺎﻟﻰ ﺧﻠﻖ ﺍﻟﻤﺨﻠﻮﻗﺎﺕ ﻭﺧﻔﺾ ﺍﻻٔﺭﺿﻴﻦ ﻭﺭﻓﻊ ﺍﻟﺴﻤﻮﺍﺕ ﻗﺒﺾ ﻗﺒﻀﺔً ﻣﻦ ﻧﻮﺭﻩ ﺳﺒﺤﺎﻧﻪ ﻭﺗﻌﺎﻟﻰ ﻭﻗﺎﻝ ﻟﻬﺎ ﻛﻮﻧﻰ ﻣﺤﻤﺪﺍً ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻓﺼﺎﺭﺕ ﺗﻠﻚ ﺍﻟﻘﺒﻀﺔ ﻋﻤﻮﺩﺍً ﻣﻦ ﻧﻮﺭ ﻓﺴﺠﺪ ﻭﺭﻓﻊ ﺭﺍﺳﻪ ﻭﻗﺎﻝ : ﺍﻟﺤﻤﺪﻟﻠﻪ ﻓﻘﺎﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻻٔﺟﻞ ﻫﺬﺍ ﺧﻠﻘﺘﻚ ﻭﺳﻤﻴﺘﻚ ﻣﺤﻤﺪﺍً ﻓﺒﻚ ﺍٔﺑﺪﺍٔ ﺍﻟﻤﺨﻠﻮﻗﺎﺕ ﻭﺑﻚ ﺍٔﺧﺘﻢ ﺍﻟﺮﺳﻞ

‘আল্লাহ তা‘আলা যখন সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করলেন এবং জমিনকে নিচে ও আসমানকে উপরস্থ করতে, (তখন) তিঁনি নিঁজ নূর হতে মুষ্ঠি নূর নিলেন এবং এর উদ্দেশ্যে বললেন (স্বীয় নূরের বিচ্ছুরনকে সম্বোধন করলেন)- তুমি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হয়ে যাও। অতঃপর ঐ নূরের বিচ্ছুরন এক নূরানী সত্ত্বায় সৃষ্টি হয়ে সিজদায় পতিত হয়ে গেলেন। অনন্তর সিজদা হতে তাঁর মাথা মুবারক উত্তোলন করতঃ বললেন আলহামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর)।অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করলেন,এজন্যইতো আঁপনাকে সৃষ্টি করলাম এবং নাম রাখলাম মুহাম্মদ (সর্বাধিক প্রশংসিত)।আঁপনার মাধ্যমে সৃষ্টি রাজির সুচনা করব এবং আপনার দ্বারাই রিসালাতের সমাপ্তি ঘটাবো।’ 

[ইমাম ইবনু জাওযী, আল মাওলিদুল আরুস: ১৬; ইমাম আবদুর রহমান ছাফুরী শাফেয়ী, নুজহাতুল মাজালিস: ১/২৫২, ইবনে আব্বাস হতে]


আবার লক্ষ্য করুন: হযরত আদম (আঃ)-এঁর অন্ধকার দেহে রুহ প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর ললাটে হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ)-এঁর নূর মোবারকের অংশবিশেষ স্থাপন করা হয় এবং এতে দেহের ভেতরে আলোর সৃষ্টি হয়। তখনই হযরত আদম (আঃ) মানবরূপ ধারণ করেন এবং হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করেন।

আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ)-সৃষ্টি হয়েই প্রথমে পাঠ করেছিলেন আলহামদুলিল্লাহ। তাই আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির প্রথম প্রতিনিধি হযরত আদম (আঃ) এবং সমগ্র বিশ্ব জগতের প্রতিনিধি হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ)-এঁর প্রথম কালাম 'আলহামদুলিল্লাহ' দিয়ে কোরআন মাজিদ শুরু করেছেন (তাফসীরে নঈমী)।


এভাবে ঐ জগতের একহাজার আট কোটি বছর পর মোহাম্মদী নূর হযরত আদম (আঃ)-এঁর দেহে স্থানান্তরিত হয়। প্রথমে ললাটে, তারপর ডান হাতের শাহাদত অঙ্গুলিতে এবং পরে পৃষ্ঠদেশে সেই নূরে মোহাম্মদীকে (দঃ) স্থাপন করা হয়।এরপর জান্নাতে,তারপর দুনিয়াতে পাঠানো হয় সে নূরকে।১০৬ মোকাম পাড়ি দিয়ে তিনি অবশেষে মা আমেনার উদর মোবারক হতে মানব সূরতে ধরাধামে আত্মপ্রকাশ করেন।

[১০৬ মাকামের বর্ণনা সুন্নীবার্তা মিলাদুন্নবী সংখ্যায় দেখুন]


★১৯৭. অনাদিরূপে এক আল্লাহ তা'আলাই ছিলেন।অন্য কিছু বলিতে আর কিছুই ছিল না। আল্লাহ ছাড়া আর কিছুই নাই। এই শূন্যতার সমাপ্তি ঘটাইতে ইচ্ছা করিলেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা।যেমন, ওলীকুল শিরোমণি শায়েখ আকবর (রঃ) কর্তৃক এলহাম প্রাপ্ত এবং পূর্বাপর ওলী ও সূফী তথা আধ্যাত্মিকতায় ধন্য মহানগণ কর্তৃক গৃহীত আল্লাহ তাআলার একটি বাণীতে উলেখ আছে- “আঁমার সত্তা (জানিবার কেহ না থাকায়) অজানা ছিল; আঁমার ইচ্ছা হইল (আঁমার গুণাবলীর মাধ্যমে আঁমাকে প্রকাশ করা)-আঁমাকে জানান। সেমতে আঁমি সৃষ্টি করি জগত।”

[তথ্য সূত্র:তাফসীরে রুহুল মাআনী, পৃষ্ঠা: ১৪-২১;বুখারী শরীফ,৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ২, মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী,হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ)]


* এই বাণীর মর্ম কোরআনের একটি আয়াত দ্বারাও সমর্থিত।আল্লাহ তাআলা বলিয়াছেন-“জিন এবং মানুষ এই দুইটি জাতিকে আঁমি একমাত্র আঁমার এবাদত বা গোলামী করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিয়াছি।”

[সূত্র: আল কোরআন,সূরা যারিয়াত, আয়াত নং ৫৬,সূরা নং: ৫১]


আল্লাহ তায়ালার এই ইচ্ছার বাস্তবায়নে জগত সৃষ্টির শুভ প্রারম্ভেই আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করিলেন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ)-এঁর সৃষ্টির মূল নূরকে।এই নূরকেই পরিভাষায় বলা হইয়া থাকে “হাকীকতে মুহাম্মদিয়া”।এই নূর বা হাকীকতে মুহাম্মদীয়া বলিতে কাহারও মতে হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-এঁর পবিত্র রূহ বা আত্মা উদ্দেশ্য।আর কাহারও মতে অন্য কোন বাস্তব বস্তুবিশেষ উদ্দেশ্য। অথবা ঐ পবিত্র রূহ বা আত্মারই বাহন,কিন্তু পদার্থীয় দেহ নহে,বরং হয়ত এক বিশেষ জ্যোতির্বিম্ব,যাহার প্রতিবিম্বের বিকাশ ছিল হযরত মুহাম্মদ(ﷺ)-এঁর নশ্বর দেহ।

[তথ্য সূত্র:যোরকানী,১-৩৭; বোখারী শরীফ,৫ম খন্ড,পৃষ্ঠা: ২, মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী,হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ]


উপরোল্লিখিত আল্লাহ প্রদত্ত এলহামী বাণী ও তাহার সমর্থনে আয়াতের মর্ম ইহাই ছিল যে, “আল্লাহকে জানিবে, আল্লাহর গোলামী করিবে এই উদ্দেশেই সৃষ্ট জগতের সৃষ্টি।” সুতরাং সাধারণ নিয়ম মতেই আল্লাহ তাআলা তাঁহার প্রথম সৃষ্টি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ)-কে ঐ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের যোগ্যতায় সকলের ঊর্ধ্বে শীর্ষস্থানের অধিকারীরূপে সৃষ্টি করিয়াছেন। বোখারী শরীফের এক হাদীস আছে,নবী (ﷺ)- ফরমাইয়াছেন- “আল্লাহকে ভয় করায় এবং আল্লাহকে জানায় আঁমি তোমাদের তথা নিখিল সৃষ্টির সকলের ঊর্ধ্বে।” আল্লাহকে যে যত বেশী ভয় করিবে,সে তাঁহার তত বেশী গোলামী করিবে।

[তথ্য সূত্র: বোখারী শরীফ, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩,হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ]

মাওলানা আশরাফ আলী থানভী তাহার সীরাত সস্কলন ‘নশরুত্তীব’ কিতাবে নিজ সংযোজিত টীকায় নূরে মুহাম্মদীকে রূহে মুহাম্মদী সাব্যস্ত করিয়াছেন।

[তথ্য সূত্র: বোখারী শরীফ, ৫ম খন্ড, পৃঃ ২, হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ]

এই হাকীকতে মুহাম্মদীয়া হইল নিখিল সৃষ্টিজগতের সর্বপ্রথম সৃষ্টি।লৌহ-কলম, বেহেশত-দোযখ, আসমান-যমীন, চন্দ্র -সূর্য,ফেরেশতা এবং মানব-দানব সব কিছুই ঐ হাকীকতে মুহাম্মদিয়া বা নূরে মুহাম্মদীর পরে সৃষ্টি হইয়াছে।এই তথ্য সুস্পষ্টরূপে বিশিষ্ট সাহাবী জাবের (রাঃ) বর্ণিত এক হাদীসে উল্লেখ রহিয়াছে। জাবের (রাঃ) বলিয়াছেন,আমি একদা আরজ করিলাম ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার পিতা-মাতা আঁপনার চরণে উৎসর্গ হউক; সকল বস্তুর পূর্বে সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়ালা কোন জিনিসটি সৃষ্টি করিয়াছেন? রাসূল (ﷺ) বলিলেন, হে জাবের! আল্লাহ তায়ালা সকল বস্তুর পূর্বে সর্বপ্রথম তোমাদের নবীর নূর সৃষ্টি করিয়াছেন (যাহা) আল্লাহ (বিশেষ কুদরতে সৃষ্ট) নূর হইতে।অতঃপর সেই নূর আল্লাহর কুদরতে আল্লাহ তায়ালার নিয়ন্ত্রণাধীনে চলমান ছিল।ঐ সময় লওহ-কলম, বেহেশত-দোযখ, আসমান-যমীন, চন্দ্র-সূর্য, মানব-দানব এবং ফেরেশতা কিছুই ছিল না।”

[তথ্য সূত্র: বোখারী শরীফ, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩, হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ; যোরকানী, ১-৪৬]


এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলতে চাই যে, কোন শিল্পী নিজ দক্ষতায় সুন্দর গঠনের একটি জিনিস তৈয়ার করে; তাহা এতই সুন্দর হয় যে, স্বয়ং গঠনকারী শিল্পী তাহারই হাতে গঠিত জিনিসটির প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়ে, সে তাহাকে আদর করে, ভালবাসে। শিল্পীর নিজ হাতে গড়া বস্তু তাহার দক্ষতায় এতই সুন্দর ও মনোরম হয় যে, স্বয়ং শিল্পী তাহার ভালবাসায় মুগ্ধ হয়। এমনকি শিল্পী প্রদর্শনী করিয়া তাহার গুণ গরিমারি প্রচার করে। আল্লাহ তাআলাও হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ)-এঁর ক্ষেত্রে তাহাই করিয়াছেন।


নবী (ﷺ) নূরী,তাঁর উপর যে হাদীসটি আছে যেমন: জাবের বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা আমি রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেসা করি,হে আল্লাহর রাসূল! আঁপনার প্রতি আমার বাবা--মা কুরবান হোক, আল্লাহ তায়ালা সব কিছুর আগে কী সৃষ্টি করেন? নবী (ﷺ) বলেনঃ হে জাবের! আল্লাহ তায়ালা সমস্ত বস্তুর পূর্বে তাঁর নূর দ্বারা তোমার নবীর নূরকে সৃষ্টি করেন। তারপর সেই নূর নিঁজ ক্ষমতায় আল্লাহর আদেশে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়।সেই সময় লউহ, কলম, জান্নাত, জাহান্নাম, ফেরেশতা, আসমান-যমীন, সূর্য-চন্দ্র, জিন, মানুষ কোন কিছুই ছিলনা।” এই হাদীসটি বিংশ শতাব্দীর কথিত শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী বাতিল বলে আখ্যা দিয়েছেন।তিনি বলেন সৃষ্টির প্রথম বস্তু হচ্ছে কলম, নবীর নূর নয়। প্রথম সৃষ্টি নবীর নূর বলে যে হাদীস প্রচার করা হয় তা জাল কথা,হাদীস নয়।

[সূত্র: সিল সিলাতুল আহাদীছ আস স্বহীহা (সহীহ হাদীস সিরিজ), হাদীস: ৪৫৮; গ্রন্থস্বত্ত: নাবী (ﷺ) কি নূরের তৈরী, পৃষ্ঠা: ৩২, প্রণেতা: আবদুর রাকীব (মাদানী), মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগ,সউদী আরব]


সর্বপ্রথম নাসিরুদ্দীন আলবানীর একটু পরিচয় করিয়ে দেই, তিনি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি সউদী বংশের শাসকদের প্রস্তাব করেছেন মহানবীর পবিত্র রওযার সবুজ গম্বুজটি ভেঙ্গে ফেলার।সে বলেছে, ‘এটি আফসোসের বিষয় যে,দীর্ঘদিন হল রাসূলের কবরের উপর একটি গম্বুজ প্রস্তুত হয়েছে...আমার বিশ্বাস সউদী সরকারের একত্ববাদের দাবী যদি সত্য হয়ে থাকে তবে তাদের উচিত তা চূর্ণ করে মসজিদে নববীকে তার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা।

[সূত্র: তাহযীরুল মাসাজিদি মিন ইত্তিখাযিল কুবুর মাসাজিদা, আলবানী, পৃষ্ঠা: ৬৮-৬৯; ওয়াহাবীদের সৃষ্ট সংশয়ের অপনোদন (ইসলামী সেবা দপ্তর, কোম, ইরান)]


আমার কথা হচ্ছে,আমরা রাসূল (ﷺ) -কে দেখিনি কিন্তু তাঁর স্মৃতি নিয়ে তাঁকে ভালোবাসি,মনেপ্রানে বিশ্বাস করি।তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসার মারফতে তাঁর দর্শন লাভ করি।রাসূল (ﷺ)-আজ আমাদের মধ্যে প্রকাশ্যে নেই কিন্ত তাঁর রওযা শরীফ আছে আর এটাই আমাদের জন্যে আল্লাহকে পাওয়া ও সারা জাহানের মাখলুকাতকে প্রমান দেওয়ার একটি নিদর্শন।যারা রাসূল (ﷺ)-কে ভালোবাসে তাদের জন্যে রাসূলের রওজার গম্বুজতো দূরের কথা তাঁর ছায়াও একটি যিয়ারতের উৎস।তাহলে যে ব্যক্তি তার নিজের চোখে দেখা এই নিদর্শনটিকে মিটিয়ে ফেলতে চায়,তার কাছে রাসূল (ﷺ)-এঁর নূর তো অবিশ্বাসযোগ্য হবেই। আর তারা ‘রাসূল (ﷺ)-এঁর নূর সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয়েছে’ সেটা মানতে রাজি না কিন্তু ‘কলম’ ঠিকই মানতে রাজি আছেন।


পাঠকবৃন্দের কাছে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (ﷺ) অসংখ্য নাম সমূহের গুণাবলী থেকে শুধুমাত্র কয়েকটি নামের অর্থ তুলে ধরতে চাই।যেমন,নবীজী (ﷺ)-এঁর এই নামটি ‘সাইয়্যেদ’ অর্থ সর্দার বা প্রধান,নবীজী নিখিল সৃষ্টির প্রধান, নবী ও রাসূলগণের প্রধান। ‘মোকাফফা’ অর্থ সর্বশেষে প্রেরিত।হযরত মোহাম্মদ (ﷺ) সর্বশেষ পয়গম্বর।‘সিরাজুম মুনীর’ অর্থ দীপ্ত সূর্য।নবী (ﷺ) দীপ্ত সূর্য অপেক্ষা অধিক ভাস্কর ছিলেন।

[সূত্র: বোখারী শরীফ, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৪৭, হাঃ ১৬৬২, হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ]


নবী করিম (ﷺ)-এঁর নূর মোবারক মাখলুকাতের মধ্যে সর্বপ্রথম সৃষ্ঠি করা হইয়াছে।যেমন হাদীস শরীফে আছে নবী করীম (ﷺ) বলেন হে জাবের আল্লাহ পাক সর্ব প্রথম তোমাদের নবীর নূর পয়দা করিয়াছেন।

[তথ্য সূত্র: শানে মাহবুব (সঃ), পৃষ্ঠা ৩৮,তাবলীগী কুতুবখানা,চক বাজার ঢাকা]


কাজেই চাঁদ সূরুজের অস্তিত্ব,রৌশনী সবকিছুই নূর নবী হযরত মোহাম্মদ (ﷺ) ফয়েজের কারণেই বিদ্যমান।নবী করিম (ﷺ) যদিও কবর শায়িত রহিয়াছেন কিন্তু তাঁহার অস্তিত্ব হইতেই চাঁদ সূরুজ আলোক লাভ করিতেছে।সমগ্র বিশ্বজগতের অস্তিত্ব তাঁহার মাধ্যমে লাভ হইয়াছে ইহা যেমন সত্য তেমন বিশ্বজগতের সচল থাকার মূলেও নবী করিম (ﷺ)-এঁর অস্তিত্ব কাজ করিতেছে। আধ্যাত্মিক সাধনা এবং রিয়াজতের মাধ্যমে যে ব্যক্তি নিজের অন্ত:করনকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করিয়া লয় সেই ব্যক্তি ফেরেশতার বৈশিষ্ঠ অর্জন করে।

[তথ্যসূত্র: শানে মাহবুব (সঃ),পৃষ্ঠা ৭১,তাবলীগী কুতুবখানা, চক বাজার ঢাকা)]


ইসলাম মাওলানা মোহাম্মদ কাসেম নানুতবী লিখিত কাছিদায়ে বাহরিয়া গ্রন্থের কয়েকটি কবিতার অর্থ নীচে উলেখ করা যাইতেছে।তিনি লিখিয়াছেন,আঁপনি(রাসূল (ﷺ) যমিনের সকল সৃষ্টির গৌরব।আঁপনি সকল পায়গাম্বারের মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ।অন্যান্য নবী যদি ফুল হন তবে আপনি ফুলের ঘ্রান। অন্যান্য নবী সূর্যের কিরণ হইলে আপনি হইলেন সূর্য।আঁপনি সমগ্র সৃষ্টিকুলের প্রানস্বরূপ।আঁপনি দৃশ্যমান নূর। বিশ্বজগত আঁপনার উছিলায় সৃষ্টি হইয়াছে।আঁপনার নূরের বদৌলতে অস্তিত্ব হীনতা হইতে সকল কিছু অস্তিত্ব লাভ করিয়াছে।বিশ্বজগতের সকল প্রকার পূর্ণতার সমাবেশ আপনার মধ্যে রহিয়াছে।আঁপনার মতো কামালাত ও বৈশিষ্ট অন্য কাহারো মধ্যে নাই। আঁপনার মর্তবায় অন্য কোন নবী পৌছিতে পারে নাই। মোজেযার অধিকারী নবীগণও আঁপনার তুলনায় নিশপ্রাণ।আঁপনার পূর্ববতী নবীগণ আঁপনার উম্মত হওয়ার আগ্রহ ও আকাঙ্খা ব্যক্ত করিয়াছেন। আঁপনার নূর প্রকাশ না পাইলে আল্লাহ পাক সৃষ্টির কাজে হাত দিতেন না। হযরত মুসা (আঃ) আল্লাহ পাকের দীদার পাইতে চান অথচ স্বয়ং আল্লাহ পাক আঁপনার সাক্ষাত চাহিয়াছেন।জমিন ও আসমান কখনো এক সমান হইতে পারেনা।

[তথ্য সূত্র: প্রিয় নবী (সঃ) এর আদর্শ জীবন, পৃষ্ঠা ৮৬, তাবলীগী কুতুবখানা, চক বাজার ঢাকা]


রাসূলুলাহ (ﷺ) বলিয়াছেন-আঁমি একটি কথা বলিতেছি; ফখর বা গর্ব করা উদ্দেশ্য নহে। ইব্রাহীম (আঃ) খলীলুলাহ (অর্থাৎ তিঁনি আলাহকে দোস্ত বানাইয়া ছিলেন), মুসা (আঃ) সফিউলাহ (অর্থাৎ তিঁনি আল্লাহ কর্তৃক বৈশিষ্ট প্রদত্ত), আর আমি হাবিবুলাহ (অর্থাৎ আমাকে স্বয়ং আল্লাহ তাঁহার দোস্ত বানাইয়াছেন ভালবাসিয়াছেন)।

[তথ্য সূত্র: মেশকাত শরীফ; বোখারী শরীফ, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা:৪, মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী,হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ]


কোরআন মাজীদে উদ্ধৃত হয়েছে “ওয়ামা খালাকনাস্ সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্ব” এই তাফসীরটি হযরত জাবেরের বর্ণনার অনুকুলে।তিনি বলেছেন, আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথমে আহমাদ মোস্তফার (ﷺ) রূহ সৃষ্টি করেছেন। সেই রূহ থেকে সৃষ্টি করেছেন আরশ, কুরসি, আকাশ, পৃথিবী এবং সমগ্র সৃষ্টি।

[তথ্য সূত্র: মাদারেজুন্ নবুওয়াত, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৩, শায়েখ আবদুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী (রহঃ), সেরহিন্দ প্রকাশন, সন-জুন ১৯৯৯ ইংরেজী]


আল্লাহ তায়ালার একটি নাম নূর।নূর শব্দটির রয়েছে বিভিন্নরকম অর্থ।যেমন, নূর বহনকারী, নূরের স্রষ্টা. আকাশ ও পৃথিবীকে নূরের মাধ্যমে আলোকিতকারী, আরেফগণের অন্তরে হেদায়েতে ও রহস্যের আলো প্রজ্জ্বলকারী ইত্যাদী। আল্লাহ পাক মোস্তফা (ﷺ)-কেও নূর নামে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন তিনি এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট -আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এসেছে নূর এবং সুস্পষ্ট কিতাব।” অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, “ওয়া সিরাজাম মুনিরা” অর্থাৎ তিঁনি উজ্জ্বলকারী আলোকবর্তিকা।রাসূল পাক (ﷺ) যে নূর তার কারণ হচ্ছে তিঁনি আল্লাহতায়ালার আহবানকে প্রোজ্জ্বল করেছেন, জ্বালিয়েছেন নবুয়তের নূর এবং সত্য ধর্ম ইসলামের মাধ্যমে আরেফগণের হৃদয়কে করেছেন আলোকিত।

[তথ্য সূত্র: মাদারেজুন্ নবুওয়াত,৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৩, শায়েখ আবদুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী (রহঃ), সেরহিন্দ প্রকাশন]


রাসূল (ﷺ) এরশাদ করেছেন,আল্লাহ তায়ালা আঁমার উপর যখন তাঁর নেয়ামতের বহিঃপ্রকাশ চাইলেন,তখন এরশাদ করলেন,হে মুহাম্মদ (ﷺ) আঁপনি যখন ভূত চতুষ্টয়ের মধ্যে ছিলেন তখন আঁমি আঁপনার নূরকে ডাক দিয়েছিলাম আর আঁপনার উম্মতকেও ডাক দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো, আঁপনার উম্মতের কথা মুসা (আঃ)-কে শোনাবো।

[সূত্র: মাদারেজুন্ নবুওয়াত,২য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৮৮, সেরহিন্দ প্রকাশন, সন-ডিসেম্বার ১৯৯৯]


রমযান মাস,অমাবস্যা-পূর্ব অন্ধকার, রজনী গভীর, লোকালয় হইতে বহু দূরে হেরা পর্বতের উচ্চ শৃঙ্গে নিভৃতি প্রকোষ্ঠে নবীজী (ﷺ) ধ্যানমগ্ন।এমন সময় হঠাৎ মহাসত্যের আগমন হইল। ফেরেশতা জিব্রাইল (আঃ) ঐ প্রকোষ্ঠে তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন এবং সালাম করিলেন। ফেরেশতারা নূরের তৈয়ারী; বহন করিয়া আনিয়াছেন আল্লাহ তায়ালার কালাম, তাঁহার নূর; এইসব নূরের আকর্ষণে নবীজী(ﷺ)-এঁর জড় দেহের আবেষ্টনে লুক্কায়িত মহানূরও পৃতিভাত হইয়াছে অসাধারণভাবে।অতএব হেরা গুহায় এখন নূর! নূর! সবই নূর।নবীজী (ﷺ)-এঁর ভিতরে বাহিরে নূরের জৌলুসে নূরই নূর হইয়া গিয়াছে। এই মহা মহূর্তে তাঁহার দেহ-মনের অবস্থা একমাত্র তাঁহারই অনুভব করার কথা। ব্যক্ত বা বর্ণনা করার আয়ত্ত

বহির্ভূত।নিভৃত গিরিগহবরের এই অভূতপূর্ব মুহুর্তটি মোস্তফার হৃদয়ে কি রেখাপাত করিয়াছিল তাহা কি কোন মানুষ নির্ণয় করিতে পারে?(ﷺ)!

[তথ্য সূত্র: বোখারী শরীফ,৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৮৩,

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ