বাংলা দ্বিতীয় পত্র -নির্মিত - পারিভাষিক শব্দ পর্ব -১

 


প্রশ্ন ১। পারিভাষিক শব্দ বলতে কী বোঝ? কয়েকটি পারিভাষিক শব্দের উদাহরণ দাও।

 অথবা, পারিভাষিক শব্দ কাকে বলে? বাংলা ভাষায় পারিভাষিক শব্দের গুরুত্ব আরোপ কর।

অথবা, পরিভাষা বলতে কী বোঝ? পাঁচটি পারিভাষিক শব্দের উদাহরণ দাও

অথবা, পারিভাষিক শব্দের প্রয়োজনীয়তা কী দেখ ।


উত্তর : পারিভাষিক শব্দ : বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত কতকগুলো বিদেশি শব্দের সরাসরি কোনো প্রতিশব্দ না থাকায় ঐ শব্দগুলোকে বোঝানোর জন্য যেসব বাংলা শব্দ ব্যবহার করা হয় সেগুলোকে পারিভাষিক শব্দ বলা হয়। পারিভাষিক শব্দের গুরুত্ব / প্রয়োজনীয়তা: বাংলা ভাষায় পারিভাষিক শব্দের গুরুত্ব সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-


প্রথমত, বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন বিদেশি শব্দের সরাসরি কোনো প্রতিশব্দ না থাকায় ঐ শব্দগুলোকে বোঝানোর জন্য পারিভাষিক শব্দের প্রয়োজন রয়েছে।


দ্বিতীয়ত, জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক শব্দকেই বিশিষ্ট অর্থে বা পারিভাষিক শব্দরূপে গ্রহণ করা প্রয়োজন হয়।


তৃতীয়ত, বাংলা ভাষার মধ্যে অনেক বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণ ঘটেছে। এর মধ্য থেকে বাংলা শব্দভাণ্ডারে কিছু শব্দ গৃহীত হয়েছে আবার কিছু বর্জিত হয়েছে। অর্থাৎ পারিভাষিক শব্দ বাংলা ভাষার বিকল্প এবং সহজবোধ্যতার জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে ।


প্রশ্ন ২ ॥ পরিভাষা ও বিদেশি শব্দের পার্থক্য লেখ।


উত্তর : পরিভাষা ও বিদেশি শব্দের পার্থক্য : পরিভাষা ও বিদেশি শব্দের মধ্যে সাধারণভাবে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত না হলেও মূলত বিষয় দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। কোনো ভাষা যখন পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার শব্দকে অনুবাদ আকারে বা যৎসামান্য পরিবর্তন করে ব্যবহার করে তখন এটিকে পরিভাষা বলে এবং শব্দগুলোকে পারিভাষিক শব্দ বলে। কিন্তু বিদেশি শব্দ হলো কোনো ভাষার মূল শব্দ। পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষাই অন্যান্য সমৃদ্ধ ভাষা থেকে শব্দ চয়ন করে নিজস্ব শব্দভাণ্ডারকে শক্তিশালী করে। বাংলা ভাষাও পরিভাষার মাধ্যমে বা সরাসরি নানা প্রয়োজনে বিদেশি শব্দ গ্রহণ করে নিজ শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। বিদেশি যে শব্দগুলো বাংলা ভাষায় অতিপরিচিত এবং স্থায়ী আসন করে নিয়েছে সেগুলোর পরিভাষার কোনো প্রয়োজন নেই। যেমন- চেয়ার, টেবিল, আখের, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি। এগুলো বাংলাভাষী জনগণ অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করে, তাই শব্দগুলো এখন বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ বলে বিবেচিত। কিন্তু অফিস-আদালত, শিক্ষা সংক্রান্ত বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কিছু কিছু শব্দ রয়েছে যেগুলোর পরিভাষা করার প্রয়োজন রয়েছে।


প্রশ্ন ৩। পারিভাষিক শব্দ প্রণয়নের নীতিমালা আলোচনা কর।


| উত্তর : পারিভাষিক শব্দ প্রণয়নের নীতিমালা : প্রতিটি ভাষা তার আপন প্রয়োজনে নিজস্ব শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে। যখন ভাষায়


কোনো শব্দের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তখন অন্য ভাষার শব্দ পরিভাষার মাধ্যমে গ্রহণ করে সে প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। তবে ইচ্ছে করলেই যেকোনো শব্দ গ্রহণ করা যায় না। পরিভাষার জন্য শুধু প্রতিশব্দ বের করলেই চলবে না, একে হতে হবে সুনির্দিষ্ট অর্থবহ এবং শ্রুতিমধুর। পরিভাষার জন্য মূলত ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া উচ্চারণের সহজসাধ্যতা, সংক্ষিপ্ততা ও প্রয়োগ সুবিধার প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে। পারিভাষিক শব্দ প্রণয়নের নীতি সম্পর্কে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে নূরুল হুদা প্রদত্ত মতামত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি পরিভাষা নির্মাণের জন্য বেশকিছু নীতিমালা উপস্থাপন করেছেন। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নীতিমালা নিচে দেওয়া হলো-  

১. একই অর্থ নির্দেশের জন্য বিভিন্ন শব্দ এবং বিভিন্ন অর্থ নির্দেশের জন্য একই শব্দ বৈজ্ঞানিক তথ্যাদির সুষ্ঠ প্রকাশ ব্যাহত করে।


বিধায় যথাসম্ভব একটিমাত্র ইংরেজি পারিভাষিক শব্দের জন্য একটিমাত্র বাংলা প্রতিশব্দ নির্বাচন করতে হবে।

 ২. ইংরেজি পরিভাষার সমার্থক শব্দসমূহের জন্য পৃথক পৃথক বাংলা প্রতিশব্দ যাতে তৈরি না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। যেমন : পরমাণু বিজ্ঞানে ব্যবহৃত decay constant, disintegration constant, transformation constant, এ তিনটি সমার্থক


শব্দের জন্য তিনটি পৃথক বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি না করে একটিমাত্র বাংলা প্রতিশব্দ নির্বাচন করতে হবে।


৩. কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ যদি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন অর্থ নির্দেশ করে তাহলে পৃথক পৃথক বাংলা প্রতিশব্দ নির্বাচিত হতে পারে। তবে ভিন্ন প্রতিশব্দ যদি ইতোমধ্যেই চালু না থাকে তাহলে ইংরেজির মতো বাংলা বিভিন্ন শাখায় এ প্রতিশব্দ রাখা যায় কিনা ভেবে দেখতে হবে।


৪. বাংলা প্রতিশব্দ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইংরেজি শব্দটির শুধু বাহ্যিক অর্থ বিবেচনা না করে শব্দটি বিজ্ঞানের পরিভাষায় যে বিশেষ সভায় প্রতীকী নাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার প্রতি লক্ষ রেখে, অর্থাৎ অন্তর্নিহিত অর্থব্যঞ্জনা অনুধাবন করে উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ নির্বাচন করতে হবে।


৫. নির্বাচিত শব্দ যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত হতে হবে কেননা পারিভাষিক শব্দ মূলত প্রতীকী নাম মাত্র।


৬. যেসব ইংরেজি পারিভাষিক শব্দ বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক সাহিত্যে বহুল প্রচলিত সেগুলো যথাসম্ভব বাংলা পরিভাষায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।


 ৭. তথাকথিত আন্তর্জাতিক শব্দ অনুবাদ না করে সরাসরি বাংলায় গ্রহণের ক্ষেত্রে শব্দগুলো আন্তর্জাতিকতার দাবি বিবেচনা করে দেখতে হবে।


 ৮. কোনো ইংরেজি শব্দ বাংলায় গ্রহণের ক্ষেত্রে সে শব্দের সঙ্গে বিভিন্ন প্রত্যয়যোগে নিষ্পন্ন শব্দগুলোর বাংলাকরণের সম্ভাব্যতাও বিচার করে দেখতে হবে। ৯. বিদেশি উপসর্গ ও প্রত্যয়গুলোর স্থলে বাংলা উপসর্গ প্রত্যয়ের ব্যবহার যথাসম্ভব সর্বত্র একরূপ হতে হবে।


 ১০. পারিভাষিক শব্দ শ্রুতিমধুর ও সহজবোধ্য হতে হবে, এমন দাবি মেটানোর চেষ্টা যেখানে সম্ভব সেখানে করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, শ্রুতিমাধুর্য এবং সহজবোধ্যতার চেয়েও যে গুণটি পারিভাষিক শব্দের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা হলো দ্ব্যর্থহীনতা।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ