উহুদের যুদ্ধে ইতিহাস | উহুদের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল


 উত্তুদের যুদ্ধ ( ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ )যুদ্ধের কারণ বদরের যুদ্ধে কুরাইশগণ আর্থিক , সামরিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল । কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় বীর আবু জাহল ও উতবা প্রাণ হারিয়েছিল । বদরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কুরাইশ দলপতি আবু সুফিয়ান প্রতিজ্ঞা করেন যে , প্রতিশোধ গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি নারী অথবা তৈল স্পর্শ করবেন না । এ সময় মদিনার ইহুদিগণ কুরাইশদের কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করে । ইহুদি কবি কা'ব বিন আশরাফ কবিতা রচনা করে দুধূর্ষ বেদুইন সম্প্রদায়কেও প্ররোচিত করতে থাকে । 

মদিনার প্রাধান্য এবং ইসলামের রাজনৈতিক , ধর্মীয় , সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধিতে কুরাইশগণ আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হারানোর আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়ে । উপরন্তু হাশেমী গোত্রের হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একচ্ছত্র আধিপত্য লাভ এবং তার নেতৃত্ব মদিনার ক্রমোন্নতি গোত্রীয় স্বার্থের পরিপন্থী হলে উমাইয়া নেতা আবু সুফিয়ানের গাত্রদাহ দেখা দেয় । বস্তুত কুরাইশ গোত্রের হাশেমী ও উমাইয়া শাখা দুটির পুরানো দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা লাভ করলে যুদ্ধ অবধারিত হয়ে পড়ে ।

  যুদ্ধের ঘটনা : আবু সুফিয়ান ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে ৩০০ উষ্ট্রারোহী ও ২০০ অশ্বারোহীসহ ৩০০০ সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে মদিনার পাঁচ মাইল পশ্চিমে উহুদ উপত্যকায় সমবেত হলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) ১০০ জন বর্মধারী , ৫০ জন তীরন্দাজসহ মাত্র ১০০০ জন মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । 

পথিমধ্যে মোনাফেক সর্দার আবদুল্লাহ বিন উবাই তার ৩০০ জন অনুচরসহ দলত্যাগ করলে শেষ পর্যন্ত মাত্র ৭০০ জন মুসলিম যোদ্ধা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) উহুদ পাহাড়ের গোলাকার অংশের বাইরে থেকে যুদ্ধ চালাবার মনস্থির করেন এবং সেভাবে সৈন্য সমাবেশ করেন ।

 মুসলিম শিবিরের পশ্চাতে বাম পাশে একটি গিরিপথ ছিল । পেছন দিক থেকে যাতে শত্রুরা অতর্কিত আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়েরের নেতৃত্বে ৫০ জন তীরন্দাজকে গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথটির প্রহরায় নিযুক্ত করেন এবং মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) এর সুস্পষ্ট নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এই স্থান ত্যাগ করতে নিষেধ করেন ।

 প্রথমদিকে মুসলমানরা পর পর সাফল্য লাভ করে । শত্রুবাহিনী দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন শুরু করেন । যুদ্ধের প্রাথমিক সাফল্যের উল্লাসে মুসলিম সৈন্যবাহিনী শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেলে এবং গিরিপথের রক্ষণাবেক্ষণের পরিবর্তে গনিমাতের মাল সংগ্রহে নিয়োজিত হয় । মুসলিম বাহিনীর এই বিশৃঙ্খলার সুযোগে দুর্ধর্ষ সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ পেছন থেকে অতর্কিত আক্রমণ করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং দ্রুত পলায়নে বাধ্য করে । 

স্বয়ং মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) কুরাইশ গোত্রের ইবন কামিয়ার নিক্ষিপ্ত প্রস্তরাঘাতে আহত হয়ে সংজ্ঞা ও দুটি দাঁত হারান । এই যুদ্ধে বীরকেশরী হযরত আমীর হামজা ( রা . ) সহ ৭০ জন মুসলিম যোদ্ধা শহীদ হন । আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা হামজা ( রা ) এর হূৎপিণ্ড চর্বণ করে ভক্ষণ করে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেয় । অনেক সাহাবা উহুদের যুদ্ধে আহত হন ।

" মুসলমানদের সাময়িক পরাজয়ের কারণ "

 উহুদের যুদ্ধে কুরাইশদের সৈন্য সংখ্যা মুসলমানদের তিনগুণ ছিল । কিন্তু বিধর্মীদের সংখ্যাধিক্য যে মুসলমানদের পরাজয়ের কারণ হতে পারে না , ইতোপূর্বে বদর যুদ্ধেই তা প্রমাণিত হয়েছে । তাই এ যুদ্ধে মুসলমানদের সাময়িক পরাজয়ের কারণ অন্যবিধ ছিল । 

নেতার আদেশ অমান্য ও শৃঙ্খলার অভাব 

 উহুদের যুদ্ধে মুসলমান সৈন্যগণ তাঁদের নেতার আদেশ যথাযথভাবে পালন করেনি । রসুলুল্লাহর নির্দেশ ছিল “ জয় অথবা পরাজয় কোন অবস্থাতেই মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনী যেন গিরিপথ অতিক্রম না করে । ” কিন্তু বিজয় নিজেদের করায়ত্ত মনে করে মুসলিম বাহিনী উপরিউক্ত আদেশ লঙ্ঘন করায় তাঁদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় । সে সুযোগে শত্রুপক্ষ তাদের আক্রমণ করে । নেতার আদেশ লঙ্ঘন ও শৃঙ্খলার অভাবই ছিল উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের প্রধান কারণ । 

হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) নিহত হওয়ার গুজব 

যুদ্ধে হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) নিহত হয়েছেন এমন একটি গুজব উঠলে মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে । প্রকৃপক্ষে ব্যাপারটি ছিল যুদ্ধে হযরত মুসআব ( রা . ) শাহাদাত বরণ করেছিলেন । হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর সাথে তাঁর চেহারার সাদৃশ্য ছিল । 

কর্তব্যে অবহেল 

বিজয় অবশ্যম্ভাবী মনে করে মুসলিম বাহিনী বিপুল উৎসাহে সামরিক আদর্শ রক্ষার পরিবর্তে শত্রুদের ধন - সম্পদ সংগ্রহে লিপ্ত হয়ে পড়ে । তাদের এই কর্তব্য জ্ঞান অপেক্ষা গাণিমাত লাভ প্রবল হয়ে দেখা দেয় । তাঁরা যদি তাঁদের নিজ নিজ স্থানে দৃঢ় থাকতেন , তাহলে খালিদ বিন ওয়ালিদ পশ্চাৎভাগ হতে মুসলমানদের আক্রমণ করার সুযোগ পেত না ।



খালিদের রণকৌশল

মহাবীর খালিদের রণদক্ষতা ও চাতুর্য শত্রুপক্ষের সাময়িক বিজয়কে সম্ভব করেছিল । মুসলিম সেনাদল যখন যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ত্যাগ করে গানিমাত সংগ্রহে ব্যস্ত , ঠিক সে মুহূর্তে বীরশ্রেষ্ঠ খালিদ বিন ওয়ালিদ তাদের উপর মরণপন আক্রমণ চালায় । ফলে মুসলিম সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করে ।

 যুদ্ধের ফলাফল

 উহুদের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য ইমান ও ধৈর্যের অগ্নি পরীক্ষা । এ যুদ্ধ তাদের ভক্তি , বিশ্বাস ও আত্ম জিজ্ঞাসার পরীক্ষা । বিজয়োল্লাসী বিধর্মী কুরাইশগণ মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে সাময়িক জয়লাভ করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা মানসিক ও শারীরিক শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং এ কারণে তাদের জয় ছিল পরাজয়ের নামান্তর । উহুদের অগ্নি পরীক্ষা ইসলামের দৃঢ় সংকল্প ও আত্মনির্ভরশীলতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ । 

বদরের প্রান্তরে ইসলামের সামরিক বিজয়ের প্রতীক ছিল ; কিন্তু উহুদের বিপর্যয় মুসলমানদের সুশৃঙ্খলাবদ্ধ সামরিক জাতিতে পরিণত করে । উহুদের যুদ্ধের পরাজয় থেকে মুসলমানগণ যে শিক্ষা লাভ করেন । তা পরবর্তী সময়ের সকল যুদ্ধে তাদের নিকট একটি অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে ।

উহুদের যুদ্ধের পর মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ৪০ জন বা ৭০ জন মুসলিম ধর্ম প্রচারককে নজদ পাঠান । বিরে মাউনা নামক স্থানে উপস্থিত হয়ে উক্ত দলটি আমির গোত্রের অন্যতম নেতা আমি ইবনে তোফায়েলের নিকট দূত মারফত মহানবির ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) একখানা ইসলামের দাওয়াতপত্র পাঠান । পত্র হস্তগত এবার সাথে সাথে তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে দূতকে হত্যা করে বিরে মাউনায় সসৈন্যে গমন করে বাকি ৬৯ জনের মধ্যে ৬৭ জন মুসলমানকে হত্যা করে । বিনা যুদ্ধে এত বেশি শিক্ষিত মুসলমানেরা শাহাদাত বরণ ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ