সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ: বিদায় হজ্জের ভাষণ ও তাৎপর্য

 


বিদায় হজ ( ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ ) দশম হিজরিতে হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) উপলব্ধি করলেন যে , তাঁর জাগতিক কর্তব্য শেষ হয়েছে এবং জীবন প্রদীপ নির্বাপিত হওয়ার সময়ও আসন্ন । তাই হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে ২৫ শে জিলকদ , ১০ হিজরী অর্থাৎ ২৩ শে ফেব্রুয়ারি , ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অগনিত সাহাবি সহকারে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন । ইতোপূর্বে মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) দুবার ওমরাহ পালন করেছেন । কিন্তু তখনও পর্যন্ত হজব্রত পালনের সুযোগ হয়নি । হজব্রত পালন এবং মুসলমানদের এতদসংক্রান্ত বিধি বিধান সম্পর্কে সরাসরি অবহিত করাও ছিল মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর এবার হজ যাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য । 

এটি ছিল মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর জীবনের শেষ হজব্রত পালন । এজন্য এ হজকে হিজ্জতুল বিদা ' বা বিদায় হজ বলা হয় । উল্লেখযোগ্য যে , ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে সূরা বারাত নাজিল হবার পর হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) আরবের সমস্ত গোত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য ৪ মাস সময় প্রদান করেন এবং বলেন যে , এ সময় অতিবাহিত হবার পর আল্লাহ ও তার রসুল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) কোনো প্রকার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন না । এর ফলে পরের বছর ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে হযরত ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  ) হজ উপলক্ষে ১,১৪,০০০ জন সাহাবাসহ মক্কায় গমন করতে সক্ষম হন । এ যাত্রায় তাঁর সকল সহধর্মিনী তাঁর সঙ্গে ছিলেন । কুরবানীর দেওয়ার জন্য তিনি ১০০ টি উট সঙ্গে নেন । 

যাত্রার দশদিন পর হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) ছয় মাইল অদূরে যূল তুলায়ফা নামক স্থানে পৌঁছেন এবং সেখানে হতে সাহাবিদের নিয়ে হজর পোশাক পরিধান করে ( ইহরাম বেঁধে ) একাদশ দিনে মক্কায় প্রবেশ করেন ।

 কা'বা গৃহের চতুর্দিকে সাতবার প্রদক্ষিণ ( তাওয়াফ ) করে হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) মোকামে ইব্রাহিম লেখক রহমান স্থানে নামাজ আদায় করেন । অতঃপর সাফা ও মারওয়া পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে সাতবার দৌড়ালেন । জিলহজ মাসের অষ্টম দিনে তিনি মিনায় এবং নবম দিনে আরাফাত ময়দানে পৌছান । হজ সম্পন্ন করে তিনি আরাফাতের পর্বত শিখরে দাঁড়িয়ে উপস্থিত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এক অবিস্মরণীয় ভাষণ প্রদান করেন । তাঁর এ উপদেশবাণী মুসলমানদের হৃদয়ে চিরকাল সমুজ্জল হয়ে থাকবে ।

" বিদায় হজের ভাষণ "

হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে সৃষ্টিকর্তা ও বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সমবেত জনসমুদ্রের উদ্দেশ্যে বলেন : হে মুসলমানগণ , মনোযোগ সহকারে আমার বাণী শ্রবণ কর । কারণ , তোমাদের সাথে পুনরায় মিলিত হবার সুযোগ আল্লাহ আমাকে নাও দিতে পারেন । এ দিন এ মাস সকলের জন্য যেরূপ পবিত্র , সেরূপ তোমাদের জীবন ও সম্পত্তি মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে সাক্ষাতের পূব পর্যন্ত পরস্পরের নিকট পবিত্র এবং হস্তক্ষেপের অনুপযুক্ত ।

 “ স্মরণ রেখ , প্রতিটি কাজের জন্য তোমাদেরকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে জবাবদিহি করতে হবে । ”

 “ হে সাহাবিগণ , সহধর্মিনীদের উপর তোমাদের যেরূপ অধিকার আছে , তোমাদের উপরও তাদের অধিকার অনুরূপ । আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ এবং তাঁর আদেশমত তাদেরকে তোমাদের জন্য বৈধ করে নিয়েছ । তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে ।

“ সর্বদা , অন্যের আমানত হেফাজত করবে এবং পাপ কার্য এড়িয়ে চলবে ।

 “ সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হলো । খাতকের নিকট হতে কেবল আসলই ফেরত নিবে । কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরব জাতির রক্তের বদলে রক্ত নীতি এখন হতে নিষিদ্ধ হলো । ” 

“ দাসদাসীদের সঙ্গে হৃদয়পূর্ণ ও আন্তরিক ব্যবহার করবে । তোমরা যা আহার কর , যা পরিধান কর , তাদেরকেও অনুরূপ খাদ্য ও বস্ত্র দান কর । তারা যদি ক্ষমার অযোগ্য কোনো ব্যবহার করে তা হলেও তাদের মুক্তি দান করবে । স্মরণ রেখ , তারাও আল্লাহর মাখলোক এবং তোমাদের মতো মানুষ । ” 

“ তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কারও অংশীদার করো না , অন্যায়ভাবে নরহত্যা করো না এবং ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ো না । ”

 “ হে মানবমন্ডলি , মনোযোগ সহকারে আমার বাণী অনুধাবন করতে চেষ্টা কর । স্মরণ রেখ , সকল মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই এবং তোমরা একই ভ্রাতৃত্বে ও বন্ধনে আবদ্ধ । পৃথিবীর সকল মুসলিম একই অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃ সমাজ । অনুমতি ব্যতীত কেউ কারও কোনো কিছু জোর করে কেড়ে নিতে পারবে না । ”

 “ স্মরণ রেখ , বাসভূমি ও বর্ণ - নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমান সমান । আজ হতে বংশগত কৌলিন্য প্রথা বিলুপ্ত করা হল । সেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে কুলিন , যে স্বীয়কার্যের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে আগ্রহী । পরস্পরের প্রাধান্যের একমাত্র মাপকাঠি হলো খোদাভীতি বা সৎকর্ম । ”

“ পথপ্রদর্শক হিসেবে তোমাদের জন্য আল্লাহর কালাম ( কুরআন শরীফ ) ও তাঁর প্রেরিত সত্যের বাহক রসুল করীমের চরিত্রাদর্শ ( হাদিস ) রেখে যাচ্ছি । যতদিন তোমরা কুরআন ও হাদিসের অনুশাসন মেনে চলবে ততদিনর পথভ্রষ্ট হবে না । ”

 “ হে আমার উম্মতগণ , যারা এখানে সমবেত হয়েছে , তারা অনুপস্থিত মুসলমানদের নিকট আমার উপদেশ পৌঁছে দিবে , আমার উপদেশের কথা বলবে । উপস্থিত ব্যক্তিগণের চেয়ে তারাই অধিক স্মরণ রাখতে সক্ষম হবে । ” 

নবি করীম ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) ভাষণ প্রদানের এ পর্যায়ে উর্ধ্বে হাত তুলে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বললেন , “ হে প্রভু , আমি কি তোমার বাণী সঠিকভাবে জনগণের নিকট পৌছাতে পেরেছি ? ” 

উপস্থিত উম্মতগণ গগনভেদী আওয়াজ করে বলে উঠরেন , “ হ্যাঁ , নিশ্চয়ই পেরেছেন । ”

 “ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম , তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ধর্ম হিসেবে ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম । ” ( সূরা মায়েদাঃ ৩ )

পরিশেষে হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) আবেগভরা কণ্ঠে আবার সমবেত ভক্তবৃন্দকে লক্ষ্য করে বললেন , “ তোমরা সাক্ষী , আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি বিদায় , আল - বিদা । ” 

হযরত আবু বকর ( রা . ) এই আয়াত শুনে কেঁদে ফেলেন । কারণ তিনি তাঁর ইমানী প্রজ্ঞা দ্বারা বুঝে ফেলেছিলেন , রিসালাতের মিশন যখন সম্পন্ন হয়ে গেছে , আল্লাহ তাআলা অদূর ভবিষ্যতে মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) কে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নিবেন । মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) আরাফাত থেকে মুযদালেফায় রওয়ানা দেন । সেখানে রাত্রি যাপন করেন । ফজরের নামাযের পর তিনি মুযদালেফা থেকে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন । পথে জামরায় কংকর নিক্ষেপ করেন । 

মিনায় পৌঁছে নিজের তাঁবুতে অবস্থান করেন । মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) মদিনা থেকে কুরবানীর জন্য ১০০ উট নিয়ে এসেছিলেন । ৬৩ টি উট নিজের তরফ থেকে কুরবানী করেন । এই হিসেবে ছিল তাঁর বয়সের প্রতি বছরের জন্য একটি করে । অবশিষ্ট ৩৭ টি হযরত আলী ( রা . ) কুরবানী করেন । অতঃপর মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) পবিত্র শির মুন্ডন করেন । তাতে করে ইহরাম ( হজের পোষাক ) খুলে তিনি হজের সকল আনুষ্ঠানিকতা থেকে মুক্ত হন । এই হজকে কেউ কেউ ‘ হিজ্জাতুল বিদা ' বা বিদায় হজ বলেন । কেউ কেউ হিজ্জাতুল ইসলাম , আবার কেউ কেউ হিজ্জাতুল বালাগ নামে অভিহিত করেন ।

 মূলত তিনটি নামই এই হজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে । এটা ছিল মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) এর শেষ হজ । এই হিসেবে একে বিদায় হজ বলা যায় । কারণ এরপর আর কখনও মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম . ) হজ করার সুযোগ পাননি ।

 


" বিদায় হজের তাৎপর্য "

 হযরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) - এর বিদায় হজের অভিভাষণ মুসলিম উম্মাহর জন্য সর্বকালে পথ প্রদর্শক । এই অমূল্য ভাষণে তিনি একটি আদর্শ মুসলিম সমাজ - ব্যবস্থার চিত্র জনগণের নিকট তুলে ধরেন । তাদেরকে তিনি তমসাযুগের অসাম্য , প্রতিহিংসা , নিষ্ঠুরতা , শ্রেণি বৈষম্য , সুদ প্রথার মাধ্যমে শোষণ - নির্যাতন , নারী ও দাসদাসীর প্রতি অন্যায় - অবিচার , কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রাচীন রীতিনীতি প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপ অবসানের আহ্বান জানান ।

 মহানবি ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম. ) এর বিদায় হজের ভাষণ ইসলামী রাজনীতি , সমাজনীতি , অর্থনীতি ও মানবিক অধিকারের মূলনীতি বিষয়ক একটি দলিল । এই ভাষণে মানবজীবনের আধ্যাত্মিক ও বাস্তব উভয় শিক্ষার সুস্পষ্ট প্রতিফলন রয়েছে । বস্তুত এই শিক্ষাতেই মানবজাতির মুক্তি ও শান্তি নিহিত । হযরত ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর এই বক্তব্যের আদর্শ বাস্তবায়িত হলে বর্তমানে সংঘাতময় বিশ্বে মানবজীবন নিঃসন্দেহে শান্তিময় হয়ে উঠবে । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ