দিনলিপি : 'দিনলিপি' কোনো ব্যক্তির প্রাত্যহিক জীবনে ঘটে যাওয়া বিশেষ কিছু ঘটনার লিখিত রূপ। ভোরে শয্যাত্যাগ থেকে রাতে শয্যাগ্রহণ পর্যন্ত দিনের প্রত্যেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা দিনলিপিতে লিপিবদ্ধ থাকে। লিপি অর্থ চিঠি, কিন্তু দিনলিপি সেই অর্থে চিঠি নয়। দিনলিপি আসলে ব্যক্তির ফেলে আসা দিনের হিসাবের মাপকাঠি, নিজেকে পেছন ফিরে অবলোকনের দর্পণ। ব্যক্তি সেখানে নিজের সঙ্গে দেশ-কাল, সমাজ-পরিবেশ, আচার-সংস্কৃতি, সংগতি-অসংগতি, উন্নতি-অবনতি, কল্যাণ-অকল্যাণও দেখার সুযোগ পায়। এভাবে দিনলিপি একজন ব্যক্তির জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রামাণ্য দলিল হয়ে ওঠে।
একজন ব্যক্তির বিশেষ ঘটনাগুলো দিনলিপিতে লিপিবদ্ধ থাকলে তা ঐ ব্যক্তির মানসিকতা, অভিরুচি, পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, লেখাপড়ায় নিষ্ঠা, বন্ধুবান্ধব-সহপাঠীদের সঙ্গ এবং এসবের বাইরের বিভিন্ন বিষয়ে আসক্তি, অনুরাগ প্রভৃতির ব্যাপারে এক নিখাদ তথ্যসূত্র আবিষ্কার করা যায়। দিনলিপির সাহায্যে আমরা জগদ্বিখ্যাত মহৎ ব্যক্তিদের জীবন বিকাশের নানা ঘাত- প্রতিঘাত, সময়, বিষয়, পর্যায়, পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে জানতে পারি। দিনলিপিকারদের নিঃস্বার্থ মানবপ্রীতি, সহিষ্ণু মনোভাব, সাম্যনীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে মানুষ সত্য ও সুন্দরের চর্চায় অনুপ্রাণিত হয়। আমরা দিনলিপিতে প্রতিফলিত চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা কীভাবে জনহিতকর হয়ে উঠতে পারে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। দিনলিপি থেকে সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা, সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, উৎসব, অনুষ্ঠান প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে ঐসব সংকট নিরসনের নানা রূপ কর্ম-পরিকল্পনাও তাতে পাওয়া যায়। দিনলিপি যদি যথার্থভাবে লিখিত ও রক্ষিত হয়, তবে তা থেকে একজন সংগ্রামী ও সফলকাম ব্যক্তির অঙ্কুর থেকে মহীরুহরূপে পরিণত হওয়ার গোপন সূত্রটির সন্ধান পাওয়া যায় ।
দিনলিপির কতিপয় উদাহরণ দেওয়া হলো—
• তোমার কলেজে মহান বিজয় দিবস উদযাপনের একটি দিনলিপি প্রস্তুত কর।
১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩
চট্টগ্রাম
ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেল। মা উঠে গেছেন আগেই। নাশতা তৈরি করছেন। আমাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে বললেন। আজ বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ নয় মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ শত্রুমুক্ত হয়। এই দিন চূড়ান্ত পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কাজেই আজকের দিনটি বাঙালি জাতির জন্য পরম পবিত্র ও তাৎপর্যময় দিন।
আমাদের কুমুদিনী কলেজ থেকে সকাল ৬টায় বিজয় র্যালি বের হবে। আমি যথাসময়ে পৌঁছে 'জয় বাংলা' স্লোগানমুখর বিজয় র্যালিতে অংশ নিলাম। শহরের মূল সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিজয় র্যালি আবার কলেজ গেটে এসে থামল। আমরা শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করলাম। সেখানে শহিদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে ১ মিনিট নীরবতা পালন করলাম। তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া প্রার্থনা করা হলো। পাশেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংবলিত চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করলেন কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়। ছবিগুলো সংগ্রহ করেছে জামরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রা। এতে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ, ২৫শে মার্চের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ, পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের হত্যাযজ্ঞ, মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্মম। অত্যাচার, নারীর সম্ভ্রম হরণ, নির্যাতন, গ্রামে গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য, পরাজিত পাকিস্তানি সেনাদের পিছু হটা মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন, যণ্ডযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ, মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন বৈঠক, এলাকাবাসীর সতর্ক অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে চিত্রগুলো চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল। সেগুলো অপূর্ব দীপ্তি ছড়াল হৃদয়জুড়ে। সকাল ৯টায় কলেজ মিলনায়তনে শুরু হলো আলোচনা সভা। পর্যাক্রমে দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা আবৃত্তি হলো। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন জেলা প্রশাসক টাঙ্গাইল, বিশেষ অতিথি ও আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গবেষক ও সাহিত্যিক ডা. মাহবুব সাদিক, কবি ও সাংবাদিক সাযযাদ কাদির ও কবি বুলবুল খান মাহবুব। তাঁদের তথ্যনির্ভর ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমি একটি পূর্ণ ধারণা লাভ করলাম। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে কবিতা আবৃত্তি ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করছিল কলেজের ছাত্রীরা। আমিও কবি শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতাটি আবৃত্তি করেছি। মিলনায়তনের দর্শক-শ্রোতারা দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এই উজ্জীবিত হৃদয় দেশ ও জাতির কল্যাণে অকৃপণভাবে নিবেদিত হবে। উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার সংগ্রামে বৃত্ত সৈনিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে অধ্যক্ষ মহোদয় অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।
বাসায় ফিরে এসে মাকে আমার অনুভূতি জানালাম। যাঁরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন তাঁদের মতো দেশপ্রেমিক হতে মা আমাকে আশীর্বাদ করলেন। টিভিতে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান উপভোগ করার পর রাত ১১টায় ঘুমাতে গেলাম।
0 মন্তব্যসমূহ