খলিফার জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলি : আল্লাহ তায়ালার প্রত্যাদেশ লাভ ব্যতীত খলিফাকে নবুয়তের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতে হয় । তাই তাঁকে ঐ সমস্ত আত্মিক , দৈহিক ও চারিত্রিক গুণাবলিতে গুণান্বিত হওয়া উচিত , যার দ্বারা একজন নবি গুণান্বিত হয়ে থাকেন । একজন খলিফার চারিত্রিক গুণাবলির সঙ্গে একজন নবির গুণাবলির হুবুহু মিল না থাকতে পারে । তবে , নবির সমস্ত গুণাবলির প্রতিবিম্ব খলিফার মধ্যে থাকা একান্ত প্রয়োজন । খলিফা নির্বাচনের জন্য ঐতিহাসিক ও সমাজ বিজ্ঞানী ইবনে খালদুন ৪ টি শর্ত নির্ধারণ করে দিয়েছেন
ন্যায়পরায়নতা : একজন খলিফার মধ্যে ন্যায় পরায়নতা সত্যবাদিতা ও সৎ কাজের প্রতি আগ্রহ থাকতে হবে ।
দৃঢ়চিত্ততা : ইসলামি শরিয়তের বিধান বাস্তবায়ন , ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষণাবেক্ষণ , জ্ঞান , কলাকৌশল , প্রজ্ঞা , প্রত্যয় ও সাহস অবশ্যই থাকতে হবে ।
ইন্দ্রিয় ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সুস্থতা : একজন খলিফা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হবেন । বিকলাঙ্গ হওয়া ঠিক নয় । তার চোখ , নাক , কান , কন্ঠস্বর , হাত - পা ইত্যাদির সুস্থ ও সবল থাকতে হবে ।
হযরত আবু বকর ( রা . ) এর খিলাফতের যোগ্যতা :
নিম্নলিখিত দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত আবু বকর ( রা . ) এর খিলাফত প্রাপ্তি ন্যায়সঙ্গত ও গুরুত্বপূর্ণ ঃঃ
১। পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা হযরত আবু বকর ( রা . ) - এর প্রতি ইঙ্গিত ।
২। হযরত মুহাম্মদ ( স . ) এর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ।
৩। হযরত মুহাম্মদ ( স . ) এর চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য ।
৪। হযরত আবু বকরের প্রতি মহানবি ( স . ) এর পূর্ণ আস্থা ।
৫। মহানবি ( স . ) - এর কথা ও কাজের দ্বারা হযরত আবু বকর ( রা . ) এর প্রতি ইঙ্গিত ।
৬। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে হযরত আবু বকর ( রা . ) এর মর্যাদা ।
৭। ইসলাম রক্ষায় হযরত আবু বকর ( রা . ) এর আর্থিক আত্মত্যাগ ।
দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ( রা ) এর নির্বাচন ইসলামি শরিয়ত মতে হযরত আবু বকর ( রা ) দ্বিতীয় খলিফা নির্বাচনের ব্যবস্থা করে যান । খিলাফত নিয়ে যাতে কোন রকম দ্বন্দ্ব সংঘাত সৃষ্টি না হয় , এজন্য তিনি অন্তিম অবস্থায় প্রখ্যাত সাহাবি হযরত আবদুর রহমান ( রা ) , হযরত উসমান ( রা ) হযরত সাঊদ বিন যায়েদ ( রা . ) এবং আরও বিশিষ্ট সাহাবাগণের সাথে পরামর্শ ও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যোগ্যতার বিবেচনায় হযরত উমর ( রা . ) - কে দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান ।
হযরত উমরের ( রা ) কড়া মেজাজের জন্য হযরত তালহা ( রা ) তার সম্মতি দিতে ইতস্তত কররে হযরত আবু বকর ( রা ) হযরত তালহাকে বলেন যে , রাষ্ট্রের গুরু দায়িত্ববার গ্রহণ করলেই তিনি কোমল ও দয়ালু হয়ে যাবেন । হযরত আবু বকর ( রা . ) এর ইনতিকালের পর দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে হযরত উমর ( রা . ) এর মনোনয়ন ঘোষণা করা হলে জনসাধারণ তাঁর নিকট স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন । এভাবে হযরত উমর ( রা . ) গণতান্ত্রিকভাবে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন ।
তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ( রা . ) এর নির্বাচন হযরত উমর ( রা . ) নিজ জীবদ্দশায়ই খিলাফতের উত্তরাধিকারী নির্বাচনের দায়িত্ব ( হযরত উসমান ( রা . ) , হযরত আলী ( রা ) , হযরত তালুহা ( রা . ) , হযরত যুবাইর ( রা . ) , হযরত সা'দ ( রা . ) এবং হযরত আবদুর রহমান বিন আউফকে নিয়ে গঠিত এক পরিষদের উপর ন্যস্ত করেন ।
আর তার ইনতিকালের তিনদিনের মধ্যেই মনোয়ন সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন । এ সকল সাহাবাগণের মধ্যে সবাই ছিলেন ইসলামের খেদমতে সমানভাবে নিবেদিত । শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে কেউই একে অপরকে ছাড়িয়েযাবার মত বিশেষত্ব দেখাতে পারেননি । ( হযরত আবু ওবায়দা বিন জাররাহ জীবিত থাকলে হয়ত যোগ্যতার বিবেচনায় তিনি খলিফা নির্বাচিত হতে পারতেন । কিন্তু তিনি খলিফা উত্তর ( রা ) এর আগেই ইনতিকাল করেন ।
জনগণের নিকট বেশি শ্রদ্ধাভাজান ছিলেন হযরত আবদুর রহমান ( রা ) । কিন্তু খিলাফতের গুরুদায়িত্ব গ্রহণে তিনি রাজি ছিলেন না । হযরত আলী ( রা ) ছিলেন মহানবি ( স . ) এর জামাতা ও চাচাত ভাই । শিক্ষা - দীক্ষাও শৌর্যবীর্যে তার তুলনা ছিল না । পারস্য বিজয়ী বীর হযরত সা'দ ( রা . ) এর ইসলামের জন্য অবদান ছিল অসামান্য এ সময় হযরত তালহা ( রা . ) রাজধানী মদিনায় ছিলেন না । হযরত উসমান ( রা . ) ৭০ বছরের প্রৌঢ় হলেও ইসলামের খেদমতে অকাতরে দান করেন এবং মহানবি ( স . ) এর দু'কন্যা রোকেয়া ও উম্মে কুলসুমের জামাতা হয়ে যুননুরাইন খেতাবে ভূষিত ছিলেন ।
হযরত সা'দ ( রা ) , হযরত তালহা ( রা . ) ও হযরত জুবাইর ( রা . ) খিলাফতের প্রত্যাশী ছিলেন না । এমন অবস্থায় হযরত আবদুর রহমান ( রা . ) আপসে ( রা . ) , হযরত উসমান ( রা . ) ও হযরত আলীর ( রা ) এর নাম প্রস্তাব করেন । হযরত সা'দ ( রা . ) হযরত উসমান ( রা . ) - কে সমর্থন করেন । হযরত জুবাইর ( রা ) হযরত উসমান ( রা . ) ও হযরত আলী ( রা . ) উভয়ের নাম প্রস্তাব করেন । হযরত উসমান ( রা . ) হযরত আলীকে এবং হযরত আলী ( রা . ) হযরত উসমান ( রা . ) - কে সমর্থন দিলেন । হযরত আবদুর রহমান ( রা . ) ভোটদানে বিরত রইলেন । ফলে হযরত উসমান ( রা . ) এর পক্ষে একটি ভোট বেশি পড়ে এবং খলিফা নির্বাচিত হলেন । প্রত্যেকেই তার প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন ।
হযরত তালহা ( রা ) ফিরে এলে হযরত উসমান ( রা ) তাঁকে খলিফা পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান । কিন্তু তিনি এতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন । তিনি হযরত উসমান ( রা . ) এর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন । জনসাধারণ সবাই তার প্রতি আনুগত্যের শপথে গ্রহণ করেন । এভাবে হযরত উমর ( রা . ) এর মৃত্যুর ৪ র্থ দিনে ২৪ হিজরির ১ লা মহরম ( ৬৪৪ খ্রিঃ ) হযরত উসমান ( রা ) ইসলামি জগতের তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন ।
চতুর্থ খলিফা হযরত আলী ( রা ) এর নির্বাচন খলিফা হযরত উসমান ( রা ) এর হত্যাকান্ডের পর আরবের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় । খিলাফতের পবিত্রতা ও মর্যাদা বিনষ্ট হয় । এ সময় তিনটি দলে উগ্রপন্থীরা বিভক্ত হয়ে স্ব - স্ব দলের মনোনীত ব্যক্তিকে খলিফা পদে বরণ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠে । এরূপ গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে হযরত উসমান ( রা ) এর উত্তরাধিকারী তথা পরবর্তী খলিফা নির্বাচন খুবই কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয় । বিদ্রোহী কুফাবাসীরা হযরত জুবাইর ( রা ) , বসরাবাসীরা হযরত তালহা ( রা ) এবং মিসরীয়রা ইবনে সাবার নেতৃত্বে হযরত আলীকে খলিফা হিসেবে সমর্থন করে ।
পরিশেষে হযরত উসমান ( রা ) এর হত্যার ৫ ম দিনে মিসরীয় বিদ্রোহীরা হযরত আলী ( রা ) এর নাম প্রস্তাব করেন । কুফা ও বসরার বিদ্রোহীরাও হযরত আলী ( রা . ) কে সমর্থন জানান মদিনার প্রভাবশালী নাগরিকগণের অনুরোধে হযরত আলী ( রা . ) খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি হন । জনসাধারণও তাঁর হাতে আনুগত্যের শপথ গ্রহন করেন । এভাবে গণতান্ত্রিক উপায়েই ইসলামের চতুর্থ খলিফা হিসেবে হযরত আলী ( রা . ) ( ২৩ জুন , ৬৫৬ খ্রি ) নির্বাচিত হন ।
0 মন্তব্যসমূহ